চরিত্র চিত্রণ
2021-02-07
হল বাক্-বিন্যাশ কৌশল। তবে ভাঁডুর আর একটা বড় বৈশিষ্ট্য এই যে তার আচরণ রহস্যপূর্ণ নয়, সবই সামানা সামনি সে বলে এবং করে। মুকুন্দরাম এই চরিত্র সৃষ্টিতে বহু অভিজ্ঞতার খণ্ডকে একত্রিত করে যেন একটি পরিপূর্ণ মানব চরিত্র সৃষ্টির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এই রকম চরিত্র রচনার দক্ষতা বিশ্লেষণ করেই শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় মুকুন্দরামকে আধুনিক উপন্যাসকারের স্বভাবধর্মের পূর্বসূরী বলে উল্লেখ করেছেন।
কাহিনীর কেন্দ্রে রয়েছে কালকেতু। এই চরিত্র সম্পর্কে সমালোচকরা বিশেষ উচ্ছ্বসিত নন। একথা মানতেই হয় যে কালকেতু 'ব্যাধ গোহিংসক রাড়'। সুতরাং কাব্যের নায়বরূপে তার সৃষ্টি লোক মানসেই শুরু হয়েছিল। কবি তার মধ্যে বাস্তববাদী মনোভাব পূর্ণরূপে বিকশিত করার সুযোগ নেননি। কারণ হয়তো তেমন সুযোগ ব্যবহার করতে গেলে তা শ্রোতৃমণ্ডলীর অনুমোদন পেত না। বিশেষ করে এই চরিত্রটির একমাত্র কাজ হল মর্ত্যে দেবীর পূজা প্রচার। কাব্যে তার সেই ভূমিকা ভক্তের কাছে পূর্বনির্ধারিত। কিন্তু তৎসত্ত্বেও মুকুন্দরামের এই রসবোধ চরিত্রের অঙ্কনে সম্পূর্ণ নিশ্চেষ্ট ছিল না। কালকেতু শ্রোতার কাছে যে পরিচয়ে প্রথা দেখা দেয় তা বীরের পরিচয়। সে বড় শিকারী; বনের স্বাভাবিক নিয়ম মেনে পশু শিকার তার পূর্ণ দক্ষতা প্রয়োগ করে। চণ্ডীর আশ্রয় প্রার্থী বিপন্ন পশুকূলের ক্রন্দনে কালকেতুর যোগ্যতাই স্বীকৃত হয়। তার আচার আচরণে ব্যাধ জাতির কঠোর জীবন, রুক্ষস্বভাব ও স্থূল অভ্যাসের বিবরণ দানে উচ্চবর্ণের মানবসুলভ মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছে। কবিও কালকেতুর বর্ণনায় বলেন ---
শয়ন কুৎসিত বীরের ভোজন বিটকাল ।
ছোট গ্রাস তুলে যেন তেআঁটিয়ে তাল।।
পশুরাজের সঙ্গে তার যে যুদ্ধের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তা তার বিক্রম প্রকাশের উপলক্ষ্য বটে, কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়নি। কিন্তু কালকেতুর যুদ্ধ প্রস্তুতির বর্ণনা অবাস্তব নয়---
রাঙ্গাধূলি মাখিয়া অঙ্গের কৈল বেশ।
জাল দড়ি বান্ধিয়া রঞ্জিত কৈল কেশ।।
কিন্তু এইসব বীরত্বের বিবরণ যে মঙ্গলকাব্য ধারার প্রতি আনুগত্যের চিহ্ন-মাত্র, তাতে সন্দেহ থাকে না। ব্যাধের সন্তান কালকেতু বনের পশুদের মধ্যে যে ত্রাসের সঞ্চার করেছে শিকারীর দক্ষতার জন্য, তার ফলে সাংসারিক অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। তা প্রকাশ পেয়েছে দেবীর ছলনায় কোন শিকার না পেয়ে কালকেতুর খেদোক্তিতে---
তেল লবণের কড়ি ধারি ছয় বুড়ি।
শ্বশুর ঘরের ধান্য ধারি দেড় আড়ি।।
কিরাত পাড়াতে বসি না মেলে উধার।
হেন বন্ধু জান নাহি কেহ সহে ভার।।
কালকেতুর কুটীরদ্বরে ছদ্মবেশিনী কাউকে দেখার পর কালকেতুর কাছে ফুল্লরা যখন অভিযোগ জানায় তখন তার আচরণে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত হয়েছে। সে ফুল্লরার বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে সঙ্গত কারণেই সন্দেহ প্রকাশ শ্বাশুড়ী ননদী বা সতীন না থাকলেও এবেশ কেন। তারপর পথের কাঁটা দূর করার জন্য অবশেষে চণ্ডীকে সরিয়ে নিতে শর সন্ধানে দ্বিধা করেনি। চতুর বানিয়ে মুরারী শীলের সঙ্গে তার আচরণের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পরিস্ফুট। অঙ্গুরীর মূল্য সম্পর্কে তার ধারণা সঙ্গত। তারপর ঠক প্রবঞ্চক ভাঁডু দত্তের অভব্য আচরণের জন্য তাকে যথাযথ শাস্তি দিতে পিছপা হয়নি। এখানে তার কথাবার্তায় নিপীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভূতি এবং প্রজানুরক্তির পরিচয় ধরা পড়েছে। ধূর্ত ভাঁডুর প্রতি তার উক্তি "প্রজা নাহি মানে বেটা আপনি মন্ডল / নগর ভাঙ্গিলি ঠকা করিয়া কান্দাল।।"
কলিঙ্গ রাজের সঙ্গে অনাবশ্যক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় তার উপলব্ধিও অসঙ্গত নয়---"মাংস বেচি ছিনু ভাল এবে সে পরাণ গেল।" অবশেষে সমস্যার নিরসনের কালকেতু ভাঁডু দত্তের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করে তার মতামত প্রকাশ করেছে। দুষ্কৃতির জন্য ভাঁডু দত্তকে কঠোর শাস্তি দিয়েছে দৃঢ়তার সঙ্গে। সে প্রথম জীবনে পিতা-মাতার প্রতি যেমন কর্তব্য করেছে, তেমনি পত্নী ফুল্লরার প্রতি যাথাযথ আচরণে কুণ্ঠা বোধ করেনি। তবে কোন কোন অংশে তার আচরনে যেসব অসঙ্গতি দেখা যায় তার জন্য দেবীমাহাত্ম্য সূচিত করার ব্যগ্রতা এবং হাস্যরস সৃষ্টির আগ্রহই কাজ করেছে।
![]()
হাস্যরস সৃষ্টি ঃ
মুকুন্দরামের জীবনবোধ বাস্তববাদী ছিল, একথা বলা যায়। চন্ডীমঙ্গলের কাব্য ধারায় বাস্তব জীবনের প্রতি যে স্বাভাবিক ঝোঁক দেখা গিয়েছিল, কবি তাকে নিজ ব্যক্তি প্রতিভার বিকাশে কাজে লাগিয়েছেন। বাস্তবের প্রতি ঝোঁকের অবকাশ থেকে কবি মনে সমালোচনামূলক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে তার ভূমিকা কম নয়। মঙ্গলকাব্যের উদ্ভবে যে ইহলোক বিমুখতার প্রসঙ্গে উত্থাপিত হয় তার প্রভাবে কোথাও সার্থক মানব জীবনবোধ আশা করা অসঙ্গত ছিল। কাহিনী চরিত্র ও পরিবেশ কঠোরভাব ধর্মভাবের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। সুতরাং সেই ধারায় বাস্তব বোধের ছিটে ফোঁটা থাকলেই কবির মনে এক রকম তীক্ষ্ম বিশ্লেষণী ভাব দেখা দিত। তখন সেই জীবনে বহু অসঙ্গতি ধরে ফেলে মনে মনে কৌতুক বোধ না করে পারতেন না। মুকুন্দরামের কাব্য ও মঙ্গল কাব্য, তার পরিবেশটাও দৈবভাবের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসেনি। কিন্তু কবি মনের রসবোধ বাস্তব জীবনের প্রতিরূপ আঁকতে পারাকেই যথার্থ সাহিত্য কর্ম বলে ক্ষীণভাবে আশা করলে দোষ দেওয়া যাবে না। বস্তুতঃ মুকুন্দরামের কাব্যে কবির লঘু হাস্য পরিহাস যুক্ত মন্তব্য এবং কৌতুককর পরিস্থিতির সৃষ্টি, সুযোগ থাকলে অবহেলিত হয়নি। মুকুন্দরামের হাস্য রসিকতা তাঁর জীবন রসিকতার অন্যভাবে প্রকাশ বলা যায়। সমগ্র কাব্যে কবির এই যত্র তত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
দেবখণ্ডে কবির কৌতুক প্রবনতা সংযমের চেষ্টা দেখিনা। বাউন্ডুলে শিবের সঙ্গে গৌরীর বিবাহকালে বরের শোভা দেখে সমবেত নারীদের রঙ্গ এযুগের মানদন্ডে ভব্যতার সীমা লঙঘন করেছে। কিন্তু সেযুগের বিচারে এরকম ভন্ডামি বর্ণনার দ্বারাই হাস্যরস সৃষ্টি সার্থক হত। তার মাত্রা মুকুন্দরামের কাছে অনেক সংযমের বাঁধনে ধরা পড়েছে। তারপর সেই শিব মদনমোহন রূপ ধরলে নারীরা তুলনায় আপন পতিনিন্দায় মুখর হয়ে উঠায় পরিস্থিতি আরও কৌতুককর হয়ে উঠল। এই পতিনিন্দার বর্ণনায় হাস্যকর অংশের অভাব নেই। ঘরে যখন একমুঠো চালও নেই তখন শিবের ভোজন বিলাসের ফিরিস্তি যে বিসদৃশ অবস্থার জন্ম দেয় তারও হাস্য সম্বরণ করা শক্ত।
নরখণ্ডে কবি রশি আরও আলগা করে দিতে পিছপা হননি। কালকেতুর ভোজনের বর্ণনায় শ্রোতা মাত্রেই হাস্যদমনে বার্থকাম হবে। পশুরাজার সঙ্গে কালকেতুর যুদ্ধ বিবরণেও কৌতুক করে নিতে ভুল হয় না। কালকেতুর কাছে মার খেয়ে অন্যরা যখন পলায়মান তখন ত্রাসে সিংহ পান করে নীর'। তারপ পশুগণের ক্রন্দনে কোন কোন স্থলে এমন অসঙ্গত উক্তি আছে যা হাস্যরস সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই রচিত এমন স্পষ্টই ধরা যায়। না হয় বরার এ উক্তি কেন?
শাশুড়ী-ননদ মরে দেওর-ভাসুর। / পতি গেল রতিসুখ বিধি কৈল দূর। বানর বলে বৃদ্ধ পিতামহ ছিল রাম সেনাপতি'। এরকম উক্তি যে কত ছাড়িয়ে রয়েছে। দেবী চন্ডী ছন্দবেশে মোহিনী নারীবেশে ফুল্লরা ও কালকেতুর সন্দেহ, দুশ্চিন্তা ও তাঁকে ধরে নেওয়া সিদ্ধান্ত থেকে প্রতিনিবৃত্ত করার চেষ্টা দেখে যেমন কৌতুকে মনে মনে উচ্ছ্বাসিত হয়েছেন, কাব্যপাঠে মুকুন্দরামের সার্থক রচনা কৌশলে সাধারণ পাঠক ও হাস্যরসে তৃপ্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়নি। দেবী মাহাত্ম্য শ্রবণে পুণ্য অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে নির্মল হাস্যরস উপভোগের সৌভাগ্য লাভ করেছে।
কালকেতুর সঙ্গে মুরারী শীলের আচরণ ও কথোপকথন উপলক্ষে মুকুন্দরাম কিছু কৌতুক করে নিতে ভোলেন নি। নানাদিক থেকে এই গৌন প্রসঙ্গগুলি কাব্যের একটি উজ্জ্বল মুহূর্ত সৃষ্টি করে দিয়েছে। কালকেতুকে আসতে দেখেই বৃদ্ধ বানিয়া ঘরের মধ্যে আত্মগোপন করে, কারণ পাছে মাত্র দেড়বুড়ি কড়ি শোধ দিতে বলে। তার বন্যানীও ইঙ্গিত মাত্র নিজস্ব ভূমিকা পালনে কোন ত্রুটি করে না। তারপর কালকেতু আসার প্রকৃত কারণ কানে যাওয়ার পর বনিয়ার আচরণ ---'ধনের পাইয়া-আশা / আসিতে বীরের পাশ / ধায় বন্যা খিড়কীর পথে', এবং তারপর ব্যাধকে তুষ্ট করার জন্য তার উক্তি 'বান্যাবলে ভাইপো / ইবে নাহি দেখি তো / ও তোর কেমন ব্যবহার' কথায় ও কাজে সঙ্গতিহীনতাই প্রকাশ করে। তখনও তার ব্যাধকে ঠকানোর আশা রয়েছে মনের মধ্যে, কিন্তু কালকেতুর সাতর্কতায় তাকে বলতে হয়---'এতক্ষন পরিহাস করলাম তোমারে' -- ভাইপোর সঙ্গে পরিহাসের সম্পর্ক বাঙালী পরিবার প্রতিবেশীর মধ্যে যেন কতই সুলভ। সামান্য অর্থলোভে দুই পরিণত নর-নারীর আচরণের যে ছবি মুকুন্দরাম দিয়েছেন তাতে পরিহাসরসের ভাগটা নেহাত অল্প নয়।
ভাঁডু দত্ত আলোচ্য কাব্যে বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। গুজরাট নগর পত্তন উপলক্ষ্যে তার আগমন। গোড়া থেকেই তার অচয়ণে যে সপ্রতিভতা ও অসাদাচরণের প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে তাতে এই চরিত্রটির প্রতি পাঠকের কৌতুহলের অন্ত থাকেনি। কিন্তু সেই সঙ্গে তার আচরণের মধ্যে ক্রমান্বয়ে অসঙ্গতি স্বভাবসিদ্ধ। সেজন্য কাব্যের কাহিনী ধারার এই অংশে তার
![]()
ভূমিকা গুরুতর হলেও তার সব নড়াচড়ার মধ্যে একটি হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভাঁডু দত্তের সাজসজ্জা এবং রাজাকে ভেট দেওয়ার জন্য সংগৃহীত সামগ্রীর তালিকাও হাস্যোদ্দীপক---
চুবড়ি ভরিয়া নিল কদলীর মোচা / মাগের বসন পরে ভূমে নামে কোঁচা।
মস্তকে বন্ধিল পাগ নাহি ডাকে কেশ / মৃত্তিকার তিলক কৈল রঞ্জিত কৈল কেশ।।
কালকেতু শেষ পর্যন্ত নিগ্রহ থেকে রক্ষা পাওয়ার পর ভাঁডু দত্তের বাক্ চাতুর্য তার চূড়ান্ত ভন্ডামির পরিচায়ক। তার মিথ্যা ভাষণ ও কপটাচার তখন তার ভয়ের বিষয়ে না থেকে হাসির খোরাক হয়ে দাঁড়ায়। কালকেতুর সঙ্গে সাধারণ পাঠকও একাত্ম হয়ে যায় ---"ভাডু দত্ত যত ভাবে / কালকেতু মনে হাসে / কটুভাষে বলেন বচন।" শেষ পর্যন্ত তাকে যে বিড়ম্বনাকর দৃশ্যের উদ্ভব হয়েছে তার আচরণের এই সঙ্গত পরিণতি, অন্য কিছু ভাবা যায় না। সাধারণে তার এই দুর্দশা মহানন্দে উপভোগ্য করেছে, কারও মনে এক বিন্দু করুণার সঞ্চার হয়নি।
জীবন রসিক কবি ঃ
মঙ্গলকাব্যের ছকে বাঁধা পথে কবির প্রতিভা যথার্থ স্ফূর্তি পায় না। তার কোথাও যেন এমন একটা অসংলগ্নতা সত্ত্বেও বাধ্যবাধকতা রয়েছে যাতে নব রসের আয়োজন করাই যায় না। তাছাড়া কর্মফলও দৈবানুগত্যের সীমা এতদূর বিস্তৃত যে ধারা অতিক্রম করতে গেলে ধর্মীয় ভাবকে ক্ষুন্ন করার আশঙ্কা থেকে যায়। সেজন্য কবিরা স্বাধীন আচরণ সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ থাকতে বাধ্য হন। কিন্তু মুকুন্দরামের বাস্তব বিশুদ্ধ ঘটনা ও যুক্তি পরম্পরায় বাঁধা নয় তাতে জীবনের আশা ও ভবিষ্যতের রঙীন স্বপ্নও উপেক্ষিত হয়নি। ব্যক্তিগত ভালোমন্দ বা রোমান্স কল্পনার ভূমিকাও স্বীকার করা হয়েছে। চরিত্র চিত্রণ কাহিনী বর্ণনা ও জীবনবোধ সবদিকেই কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে মুকুন্দরামকে অনন্য জীবনরসিক বলে চেনা যায়।
জীবনরসিক কথাটির তাৎপর্য মনে রেখে তার আলোচনা নিস্ফল। মানুষের জীবন দুঃখবেদনা, দারিদ্র। সুখ, প্রেম নিরাশ ও বিচ্ছেদের পুঞ্জ। তাই জীবনের ভালমন্দ সব কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়ে, তার মধ্য থেকেই রসের উপলবদ্ধিতে যিনি রসপিপাসা চরিতার্থ করতে পারেন, তিনি জীবন রসিক। তাঁর কাছে জীবনের স্বাদ গন্ধ তার সবরকম উপাদান সমন্বয়েই ধরা দেয়। অন্য কোন উপলক্ষ্য বড় হতে পারে না।
মঙ্গলকাব্য রচনা করতে গিয়ে কবিরা প্রথানুগত্য অনুমোদন করে নেন। চণ্ডীমঙ্গলের কাহিনী সেই প্রথানুসারী। কিন্তু সেই কাব্যে লোক ধারার কাহিনী যে উৎস থেকে গৃহীত সেখানেও বস্তুবাদিতার ঝোঁক দেখা গিয়েছিল। চণ্ডী বনজীবনে পুজিতা। তাই তার অনুগামী ও ভক্তেরা নিম্নসম্প্রদায়ের। সেখানে শাস্ত্র-পুরাণের দেব মাহাত্ম্য প্রভাবের পথ ছাড়া স্বাভাবিক পথে অনুপ্রবেশ করতে পারে না। তাছাড়া এদের জীবনে দেবীর অস্তিত্বের চেয়ে জীবন যাপনের কঠোরতা আরও বেশী স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ। চণ্ডীমঙ্গলের দুটি কাহিনীর মধ্যে অখেটী খন্ড বেশী চিত্তাকর্ষক। একথা সন্দেহের অতীত হলেও দেবখণ্ডের বর্ণনাতে অনেককাংশে বিরল মর্ত্য প্রীতির প্রকাশ আছে 'নীলাম্বরের খেদ' অংশে।
'এই ব্যাধ ভাল জীয়ে / তৃষাকালে পানি পিয়ে / ক্ষুধাকালে করয়ে ভোজন'। উডুনচন্ডী বাউন্ডুলে শিবকে বর রূপে পেয়ে গৌরীর খেদ স্বাভাবিক। সেজন্য গৌরী মনস্তাপে ভোগে। কিন্তু শিবকে ভোলামহেশ্বর পেয়ে অন্যদের তুলনায় তার প্রতি আমাদেরও উপেক্ষাও তাকে কম যন্ত্রনা দেয় না। তার মায়ের উপেক্ষায় গৌরী কলহ করতেও ছাড়ে না। এদিকে মহেশ্বরের নানা সুখাদ্য ভোজনের সাধ গৌরীর সংসারে যে চাপ সৃষ্টি করে তাতে দেবীর সঙ্গে দাম্পত্য কলহের সূত্রপাত হয়। তা যেমন উপভোগ্য তেমনি বরবেশী শিবকে দেখে নারীগণের পতিনিন্দাও কিছু কম নয়। সময় সুযোগ মত মুকুন্দরাম প্রকৃতিক বৃক্ষলতা, পশুপক্ষী এবং বিবিধ পুষ্পসম্ভারের বিবরণ দিতে উৎসাহ বোধ করেছেন।
গ্রন্থোৎপত্তির কারণ বর্ণনায় তথ্যগত মতভেদ থাকলেও এই বিবরণী যে সাহিত্য সৃষ্টি রূপে রসোত্তীর্ণ তাতে সন্দেহ নেই। এখানে কবির আদি বাস ভূমি ত্যাগ করে পরবর্ত্তী পৃষ্ঠপোষকের গৃহে আশ্রয় লাভে গমন পর্যন্ত ব্যাক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে এই অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ বাস্তব না হতে পারে, বাস্তবের সঙ্গে রোমান্টিক কল্পনার মিশ্রণে যে জীবন সংগ্রামের ছবি অঙ্কিত হয়েছে তার সার্থকতা প্রশ্নাতীত। যদিও এরকম প্রসঙ্গের অবতারণা মঙ্গলকাব্য ধারায় প্রথাগত। তবু্ও এস্থলে মুকুন্দরামের জীবননিষ্ঠা অন্য দৃষ্টান্তের তুলনায় স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত। দুঃখ ও নির্যাতন সহ্য করে, তা থেকে পরিত্রাণ পর্যন্ত জীবনের যে আগ্রহ তাতেই এই বিবরণ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
![]()
মুকুন্দরামের কাব্যে দুঃখের বর্ণনায় স্পষ্ঠ প্রবণতা দেখা যায়। ফুল্লরার বারমাস্যা, পশুগণের নিবেদন, কলিঙ্গ দেশে বন্যায় মানুষের দুর্গতি, শিবের অভাবের সংসার, হাটুরিয়াগণের আবেদন, কোটালের প্রতি ফুল্লরার বিনয় ইত্যাদি অংশে দুঃখের প্রসঙ্গ সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। এই সব অংশের বর্ণনায় কবির দক্ষতাও প্রশ্নাতীত। কারও মনে হওয়া স্বাভাবিক যে জীবনে দুঃখের বিস্তারিত বর্ণনা গ্রন্থভুক্ত করে কবি যেন দুঃখময় জীবনের প্রতি অন্তরের দুর্বলতা প্রকাশ করে বসেছেন। জীবনে দুঃখের ভূমিকা অনস্বীকার্য, কিন্তু মুকুন্দরাম যেন অন্য বিষয়ে যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, দুঃখের প্রসঙ্গে তার থেকে তুলনায় কৃতিত্ব অনেক বেশী। কিন্তু তাই বলে মুকুন্দরামকে 'দুঃখবাদী কবি' বলাও যুক্তিযুক্ত নয়। বরং তার বদলে কবিকে বাঙালীর গার্হস্থ্য জীবনে রসের কবি বলাই সঙ্গত। কাব্য পাঠে একটু মনোযোগী হলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কবি বাঙালীর ঘরোয়া পরিবেশকে কাব্যে রূপ দিতে বেশী আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দেবনয় সব প্রসঙ্গেই সজ্জা ভোজনে-রুচি, সামাজিক আচার ও রীতিনীতি, ধর্মীয় আচরণ, দাম্পত্য জীবন, পেশা, স্নেহ মমতা, এমনকি শিকার ও যুদ্ধপ্রসঙ্গেও বাঙালীর ঘরোয়া মনোভাবটি সবার উপরে চিহ্ন রেখে গেছে। ডঃ শ্রীকূমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই অভিমত পোষণ করেন যে মুকুন্দরামের কাব্যে বাঙালীর ঘরোয়াজীবনকে আরও নূতনভাবে আস্বাদন করতে শেখা গেছে। কবির এই ধরণের প্রবণতা আরও একটু বিস্তৃত হয়ে গুজরাটে নগর পত্তন, বারনিয়াগণের বন কাটা এবং নগরে বাস করতে মানুষদের বিস্তারিত বিবরণে আত্মপ্রকাশ করেছে। কবি অভাব ও দুঃখের চাপে অবসন্ন হননি বরং অভাব ও দুঃখকে নিয়ে কৌতুকের অবতারণা করেছেন। তাই মাঝে মাঝেই ভোজনরসের আয়োজনে কাব্যের গতিকে মন্থর করতে দ্বিধা করেননি।
মুরারি শীল এবং ভাঁডু দত্তের প্রসঙ্গেও কবির রসবোধের উজ্বল সাক্ষ্য বহন করছে। এই প্রসঙ্গে কবি তাঁর জীবন অভিজ্ঞতার পূর্ণ সদব্যবহার করেছেন। মনে হয় যেন এই শ্রেণীর চরিত্র সম্পর্কে ও মুকুন্দরামের সহানুভূতি বেশী ছিল। কেননা এই কাব্যের নায়ক নায়িকা দুটিও সমাজের অবহেলিত নিম্ন শ্রেণী থেকে আগত। তাদের জীবনে কবি যে ধারা যোগ করেছেন তাতে তাদের চরিত্রগুলিও সর্বজনীন স্তরে উন্নীত হয়েছে। ব্যাধ জীবনের রীতি ও আচার বিচারের সঙ্গে বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ের আচরণীয় বিধি বিধানও অক্লেশে যুক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু কাব্যে বর্ণিত চরিত্র ও ঘটনার বিবরণে সমাজের উচ্চস্তরের তুলনায় নিম্নস্তর বেশী সহানুভূতির ভাগি হতে পেরেছে। অনুরূপভাবে ঠক প্রবঞ্চক ও ভন্ড শ্রেণীর চরিত্রগুলিও কবির কাছে বেশী মনোযোগ লাভে ধন্য হয়েছে। মুরারী শীল আবির্ভূত হয়ে কাব্যের অতি মামুলি জীবন বর্ণনায় অভাবিত প্রাণসঞ্চার করে দিয়েছে। তারপরে ভাঁডু দত্তের প্রসঙ্গ এনে কবি সমাজের প্রবঞ্চক পরজীবীশ্রেণীর ভব্যবেশের মুখোশটা খুলে দিয়েছেন। এই সব প্রসঙ্গ আসায় কাব্যের ভাবজগত যেন অপেক্ষাকৃত দেবহলীলার কল্পলোক ত্যাগ করে মর্ত্তের মাটির সঙ্গে নাড়ির যোগকে প্রত্যক্ষ করে তুলেছে।
সব মিলিয়ে মুকুন্দরামের অভয়ামঙ্গল (আখেটী খন্ড কবির কবিত্ব, চরিত্রনির্মণ, কাহিনী বয়ন সার্থক হয়ে উঠেছে তাঁর রসবোধে, জীবানুরাগ, কৌতুকসৃষ্টি, বাঙালীয়ানা, ঘরোয়া মনোভাবের অনুসরণ এবং কাব্যদেহ নির্মাণে পরিমিতি বোধের সমন্বয়ে।
কাহিনীর কেন্দ্রে রয়েছে কালকেতু। এই চরিত্র সম্পর্কে সমালোচকরা বিশেষ উচ্ছ্বসিত নন। একথা মানতেই হয় যে কালকেতু 'ব্যাধ গোহিংসক রাড়'। সুতরাং কাব্যের নায়বরূপে তার সৃষ্টি লোক মানসেই শুরু হয়েছিল। কবি তার মধ্যে বাস্তববাদী মনোভাব পূর্ণরূপে বিকশিত করার সুযোগ নেননি। কারণ হয়তো তেমন সুযোগ ব্যবহার করতে গেলে তা শ্রোতৃমণ্ডলীর অনুমোদন পেত না। বিশেষ করে এই চরিত্রটির একমাত্র কাজ হল মর্ত্যে দেবীর পূজা প্রচার। কাব্যে তার সেই ভূমিকা ভক্তের কাছে পূর্বনির্ধারিত। কিন্তু তৎসত্ত্বেও মুকুন্দরামের এই রসবোধ চরিত্রের অঙ্কনে সম্পূর্ণ নিশ্চেষ্ট ছিল না। কালকেতু শ্রোতার কাছে যে পরিচয়ে প্রথা দেখা দেয় তা বীরের পরিচয়। সে বড় শিকারী; বনের স্বাভাবিক নিয়ম মেনে পশু শিকার তার পূর্ণ দক্ষতা প্রয়োগ করে। চণ্ডীর আশ্রয় প্রার্থী বিপন্ন পশুকূলের ক্রন্দনে কালকেতুর যোগ্যতাই স্বীকৃত হয়। তার আচার আচরণে ব্যাধ জাতির কঠোর জীবন, রুক্ষস্বভাব ও স্থূল অভ্যাসের বিবরণ দানে উচ্চবর্ণের মানবসুলভ মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছে। কবিও কালকেতুর বর্ণনায় বলেন ---
ছোট গ্রাস তুলে যেন তেআঁটিয়ে তাল।।
পশুরাজের সঙ্গে তার যে যুদ্ধের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তা তার বিক্রম প্রকাশের উপলক্ষ্য বটে, কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়নি। কিন্তু কালকেতুর যুদ্ধ প্রস্তুতির বর্ণনা অবাস্তব নয়---
জাল দড়ি বান্ধিয়া রঞ্জিত কৈল কেশ।।
কিন্তু এইসব বীরত্বের বিবরণ যে মঙ্গলকাব্য ধারার প্রতি আনুগত্যের চিহ্ন-মাত্র, তাতে সন্দেহ থাকে না। ব্যাধের সন্তান কালকেতু বনের পশুদের মধ্যে যে ত্রাসের সঞ্চার করেছে শিকারীর দক্ষতার জন্য, তার ফলে সাংসারিক অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। তা প্রকাশ পেয়েছে দেবীর ছলনায় কোন শিকার না পেয়ে কালকেতুর খেদোক্তিতে---
শ্বশুর ঘরের ধান্য ধারি দেড় আড়ি।।
কিরাত পাড়াতে বসি না মেলে উধার।
হেন বন্ধু জান নাহি কেহ সহে ভার।।
কালকেতুর কুটীরদ্বরে ছদ্মবেশিনী কাউকে দেখার পর কালকেতুর কাছে ফুল্লরা যখন অভিযোগ জানায় তখন তার আচরণে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত হয়েছে। সে ফুল্লরার বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে সঙ্গত কারণেই সন্দেহ প্রকাশ শ্বাশুড়ী ননদী বা সতীন না থাকলেও এবেশ কেন। তারপর পথের কাঁটা দূর করার জন্য অবশেষে চণ্ডীকে সরিয়ে নিতে শর সন্ধানে দ্বিধা করেনি। চতুর বানিয়ে মুরারী শীলের সঙ্গে তার আচরণের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পরিস্ফুট। অঙ্গুরীর মূল্য সম্পর্কে তার ধারণা সঙ্গত। তারপর ঠক প্রবঞ্চক ভাঁডু দত্তের অভব্য আচরণের জন্য তাকে যথাযথ শাস্তি দিতে পিছপা হয়নি। এখানে তার কথাবার্তায় নিপীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভূতি এবং প্রজানুরক্তির পরিচয় ধরা পড়েছে। ধূর্ত ভাঁডুর প্রতি তার উক্তি "প্রজা নাহি মানে বেটা আপনি মন্ডল / নগর ভাঙ্গিলি ঠকা করিয়া কান্দাল।।"
কলিঙ্গ রাজের সঙ্গে অনাবশ্যক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় তার উপলব্ধিও অসঙ্গত নয়---"মাংস বেচি ছিনু ভাল এবে সে পরাণ গেল।" অবশেষে সমস্যার নিরসনের কালকেতু ভাঁডু দত্তের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করে তার মতামত প্রকাশ করেছে। দুষ্কৃতির জন্য ভাঁডু দত্তকে কঠোর শাস্তি দিয়েছে দৃঢ়তার সঙ্গে। সে প্রথম জীবনে পিতা-মাতার প্রতি যেমন কর্তব্য করেছে, তেমনি পত্নী ফুল্লরার প্রতি যাথাযথ আচরণে কুণ্ঠা বোধ করেনি। তবে কোন কোন অংশে তার আচরনে যেসব অসঙ্গতি দেখা যায় তার জন্য দেবীমাহাত্ম্য সূচিত করার ব্যগ্রতা এবং হাস্যরস সৃষ্টির আগ্রহই কাজ করেছে।
হাস্যরস সৃষ্টি ঃ
মুকুন্দরামের জীবনবোধ বাস্তববাদী ছিল, একথা বলা যায়। চন্ডীমঙ্গলের কাব্য ধারায় বাস্তব জীবনের প্রতি যে স্বাভাবিক ঝোঁক দেখা গিয়েছিল, কবি তাকে নিজ ব্যক্তি প্রতিভার বিকাশে কাজে লাগিয়েছেন। বাস্তবের প্রতি ঝোঁকের অবকাশ থেকে কবি মনে সমালোচনামূলক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে তার ভূমিকা কম নয়। মঙ্গলকাব্যের উদ্ভবে যে ইহলোক বিমুখতার প্রসঙ্গে উত্থাপিত হয় তার প্রভাবে কোথাও সার্থক মানব জীবনবোধ আশা করা অসঙ্গত ছিল। কাহিনী চরিত্র ও পরিবেশ কঠোরভাব ধর্মভাবের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। সুতরাং সেই ধারায় বাস্তব বোধের ছিটে ফোঁটা থাকলেই কবির মনে এক রকম তীক্ষ্ম বিশ্লেষণী ভাব দেখা দিত। তখন সেই জীবনে বহু অসঙ্গতি ধরে ফেলে মনে মনে কৌতুক বোধ না করে পারতেন না। মুকুন্দরামের কাব্য ও মঙ্গল কাব্য, তার পরিবেশটাও দৈবভাবের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসেনি। কিন্তু কবি মনের রসবোধ বাস্তব জীবনের প্রতিরূপ আঁকতে পারাকেই যথার্থ সাহিত্য কর্ম বলে ক্ষীণভাবে আশা করলে দোষ দেওয়া যাবে না। বস্তুতঃ মুকুন্দরামের কাব্যে কবির লঘু হাস্য পরিহাস যুক্ত মন্তব্য এবং কৌতুককর পরিস্থিতির সৃষ্টি, সুযোগ থাকলে অবহেলিত হয়নি। মুকুন্দরামের হাস্য রসিকতা তাঁর জীবন রসিকতার অন্যভাবে প্রকাশ বলা যায়। সমগ্র কাব্যে কবির এই যত্র তত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
দেবখণ্ডে কবির কৌতুক প্রবনতা সংযমের চেষ্টা দেখিনা। বাউন্ডুলে শিবের সঙ্গে গৌরীর বিবাহকালে বরের শোভা দেখে সমবেত নারীদের রঙ্গ এযুগের মানদন্ডে ভব্যতার সীমা লঙঘন করেছে। কিন্তু সেযুগের বিচারে এরকম ভন্ডামি বর্ণনার দ্বারাই হাস্যরস সৃষ্টি সার্থক হত। তার মাত্রা মুকুন্দরামের কাছে অনেক সংযমের বাঁধনে ধরা পড়েছে। তারপর সেই শিব মদনমোহন রূপ ধরলে নারীরা তুলনায় আপন পতিনিন্দায় মুখর হয়ে উঠায় পরিস্থিতি আরও কৌতুককর হয়ে উঠল। এই পতিনিন্দার বর্ণনায় হাস্যকর অংশের অভাব নেই। ঘরে যখন একমুঠো চালও নেই তখন শিবের ভোজন বিলাসের ফিরিস্তি যে বিসদৃশ অবস্থার জন্ম দেয় তারও হাস্য সম্বরণ করা শক্ত।
নরখণ্ডে কবি রশি আরও আলগা করে দিতে পিছপা হননি। কালকেতুর ভোজনের বর্ণনায় শ্রোতা মাত্রেই হাস্যদমনে বার্থকাম হবে। পশুরাজার সঙ্গে কালকেতুর যুদ্ধ বিবরণেও কৌতুক করে নিতে ভুল হয় না। কালকেতুর কাছে মার খেয়ে অন্যরা যখন পলায়মান তখন ত্রাসে সিংহ পান করে নীর'। তারপ পশুগণের ক্রন্দনে কোন কোন স্থলে এমন অসঙ্গত উক্তি আছে যা হাস্যরস সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই রচিত এমন স্পষ্টই ধরা যায়। না হয় বরার এ উক্তি কেন?
শাশুড়ী-ননদ মরে দেওর-ভাসুর। / পতি গেল রতিসুখ বিধি কৈল দূর। বানর বলে বৃদ্ধ পিতামহ ছিল রাম সেনাপতি'। এরকম উক্তি যে কত ছাড়িয়ে রয়েছে। দেবী চন্ডী ছন্দবেশে মোহিনী নারীবেশে ফুল্লরা ও কালকেতুর সন্দেহ, দুশ্চিন্তা ও তাঁকে ধরে নেওয়া সিদ্ধান্ত থেকে প্রতিনিবৃত্ত করার চেষ্টা দেখে যেমন কৌতুকে মনে মনে উচ্ছ্বাসিত হয়েছেন, কাব্যপাঠে মুকুন্দরামের সার্থক রচনা কৌশলে সাধারণ পাঠক ও হাস্যরসে তৃপ্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়নি। দেবী মাহাত্ম্য শ্রবণে পুণ্য অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে নির্মল হাস্যরস উপভোগের সৌভাগ্য লাভ করেছে।
কালকেতুর সঙ্গে মুরারী শীলের আচরণ ও কথোপকথন উপলক্ষে মুকুন্দরাম কিছু কৌতুক করে নিতে ভোলেন নি। নানাদিক থেকে এই গৌন প্রসঙ্গগুলি কাব্যের একটি উজ্জ্বল মুহূর্ত সৃষ্টি করে দিয়েছে। কালকেতুকে আসতে দেখেই বৃদ্ধ বানিয়া ঘরের মধ্যে আত্মগোপন করে, কারণ পাছে মাত্র দেড়বুড়ি কড়ি শোধ দিতে বলে। তার বন্যানীও ইঙ্গিত মাত্র নিজস্ব ভূমিকা পালনে কোন ত্রুটি করে না। তারপর কালকেতু আসার প্রকৃত কারণ কানে যাওয়ার পর বনিয়ার আচরণ ---'ধনের পাইয়া-আশা / আসিতে বীরের পাশ / ধায় বন্যা খিড়কীর পথে', এবং তারপর ব্যাধকে তুষ্ট করার জন্য তার উক্তি 'বান্যাবলে ভাইপো / ইবে নাহি দেখি তো / ও তোর কেমন ব্যবহার' কথায় ও কাজে সঙ্গতিহীনতাই প্রকাশ করে। তখনও তার ব্যাধকে ঠকানোর আশা রয়েছে মনের মধ্যে, কিন্তু কালকেতুর সাতর্কতায় তাকে বলতে হয়---'এতক্ষন পরিহাস করলাম তোমারে' -- ভাইপোর সঙ্গে পরিহাসের সম্পর্ক বাঙালী পরিবার প্রতিবেশীর মধ্যে যেন কতই সুলভ। সামান্য অর্থলোভে দুই পরিণত নর-নারীর আচরণের যে ছবি মুকুন্দরাম দিয়েছেন তাতে পরিহাসরসের ভাগটা নেহাত অল্প নয়।
ভাঁডু দত্ত আলোচ্য কাব্যে বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। গুজরাট নগর পত্তন উপলক্ষ্যে তার আগমন। গোড়া থেকেই তার অচয়ণে যে সপ্রতিভতা ও অসাদাচরণের প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে তাতে এই চরিত্রটির প্রতি পাঠকের কৌতুহলের অন্ত থাকেনি। কিন্তু সেই সঙ্গে তার আচরণের মধ্যে ক্রমান্বয়ে অসঙ্গতি স্বভাবসিদ্ধ। সেজন্য কাব্যের কাহিনী ধারার এই অংশে তার
ভূমিকা গুরুতর হলেও তার সব নড়াচড়ার মধ্যে একটি হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভাঁডু দত্তের সাজসজ্জা এবং রাজাকে ভেট দেওয়ার জন্য সংগৃহীত সামগ্রীর তালিকাও হাস্যোদ্দীপক---
মস্তকে বন্ধিল পাগ নাহি ডাকে কেশ / মৃত্তিকার তিলক কৈল রঞ্জিত কৈল কেশ।।
কালকেতু শেষ পর্যন্ত নিগ্রহ থেকে রক্ষা পাওয়ার পর ভাঁডু দত্তের বাক্ চাতুর্য তার চূড়ান্ত ভন্ডামির পরিচায়ক। তার মিথ্যা ভাষণ ও কপটাচার তখন তার ভয়ের বিষয়ে না থেকে হাসির খোরাক হয়ে দাঁড়ায়। কালকেতুর সঙ্গে সাধারণ পাঠকও একাত্ম হয়ে যায় ---"ভাডু দত্ত যত ভাবে / কালকেতু মনে হাসে / কটুভাষে বলেন বচন।" শেষ পর্যন্ত তাকে যে বিড়ম্বনাকর দৃশ্যের উদ্ভব হয়েছে তার আচরণের এই সঙ্গত পরিণতি, অন্য কিছু ভাবা যায় না। সাধারণে তার এই দুর্দশা মহানন্দে উপভোগ্য করেছে, কারও মনে এক বিন্দু করুণার সঞ্চার হয়নি।
জীবন রসিক কবি ঃ
মঙ্গলকাব্যের ছকে বাঁধা পথে কবির প্রতিভা যথার্থ স্ফূর্তি পায় না। তার কোথাও যেন এমন একটা অসংলগ্নতা সত্ত্বেও বাধ্যবাধকতা রয়েছে যাতে নব রসের আয়োজন করাই যায় না। তাছাড়া কর্মফলও দৈবানুগত্যের সীমা এতদূর বিস্তৃত যে ধারা অতিক্রম করতে গেলে ধর্মীয় ভাবকে ক্ষুন্ন করার আশঙ্কা থেকে যায়। সেজন্য কবিরা স্বাধীন আচরণ সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ থাকতে বাধ্য হন। কিন্তু মুকুন্দরামের বাস্তব বিশুদ্ধ ঘটনা ও যুক্তি পরম্পরায় বাঁধা নয় তাতে জীবনের আশা ও ভবিষ্যতের রঙীন স্বপ্নও উপেক্ষিত হয়নি। ব্যক্তিগত ভালোমন্দ বা রোমান্স কল্পনার ভূমিকাও স্বীকার করা হয়েছে। চরিত্র চিত্রণ কাহিনী বর্ণনা ও জীবনবোধ সবদিকেই কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে মুকুন্দরামকে অনন্য জীবনরসিক বলে চেনা যায়।
জীবনরসিক কথাটির তাৎপর্য মনে রেখে তার আলোচনা নিস্ফল। মানুষের জীবন দুঃখবেদনা, দারিদ্র। সুখ, প্রেম নিরাশ ও বিচ্ছেদের পুঞ্জ। তাই জীবনের ভালমন্দ সব কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়ে, তার মধ্য থেকেই রসের উপলবদ্ধিতে যিনি রসপিপাসা চরিতার্থ করতে পারেন, তিনি জীবন রসিক। তাঁর কাছে জীবনের স্বাদ গন্ধ তার সবরকম উপাদান সমন্বয়েই ধরা দেয়। অন্য কোন উপলক্ষ্য বড় হতে পারে না।
মঙ্গলকাব্য রচনা করতে গিয়ে কবিরা প্রথানুগত্য অনুমোদন করে নেন। চণ্ডীমঙ্গলের কাহিনী সেই প্রথানুসারী। কিন্তু সেই কাব্যে লোক ধারার কাহিনী যে উৎস থেকে গৃহীত সেখানেও বস্তুবাদিতার ঝোঁক দেখা গিয়েছিল। চণ্ডী বনজীবনে পুজিতা। তাই তার অনুগামী ও ভক্তেরা নিম্নসম্প্রদায়ের। সেখানে শাস্ত্র-পুরাণের দেব মাহাত্ম্য প্রভাবের পথ ছাড়া স্বাভাবিক পথে অনুপ্রবেশ করতে পারে না। তাছাড়া এদের জীবনে দেবীর অস্তিত্বের চেয়ে জীবন যাপনের কঠোরতা আরও বেশী স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ। চণ্ডীমঙ্গলের দুটি কাহিনীর মধ্যে অখেটী খন্ড বেশী চিত্তাকর্ষক। একথা সন্দেহের অতীত হলেও দেবখণ্ডের বর্ণনাতে অনেককাংশে বিরল মর্ত্য প্রীতির প্রকাশ আছে 'নীলাম্বরের খেদ' অংশে।
'এই ব্যাধ ভাল জীয়ে / তৃষাকালে পানি পিয়ে / ক্ষুধাকালে করয়ে ভোজন'। উডুনচন্ডী বাউন্ডুলে শিবকে বর রূপে পেয়ে গৌরীর খেদ স্বাভাবিক। সেজন্য গৌরী মনস্তাপে ভোগে। কিন্তু শিবকে ভোলামহেশ্বর পেয়ে অন্যদের তুলনায় তার প্রতি আমাদেরও উপেক্ষাও তাকে কম যন্ত্রনা দেয় না। তার মায়ের উপেক্ষায় গৌরী কলহ করতেও ছাড়ে না। এদিকে মহেশ্বরের নানা সুখাদ্য ভোজনের সাধ গৌরীর সংসারে যে চাপ সৃষ্টি করে তাতে দেবীর সঙ্গে দাম্পত্য কলহের সূত্রপাত হয়। তা যেমন উপভোগ্য তেমনি বরবেশী শিবকে দেখে নারীগণের পতিনিন্দাও কিছু কম নয়। সময় সুযোগ মত মুকুন্দরাম প্রকৃতিক বৃক্ষলতা, পশুপক্ষী এবং বিবিধ পুষ্পসম্ভারের বিবরণ দিতে উৎসাহ বোধ করেছেন।
গ্রন্থোৎপত্তির কারণ বর্ণনায় তথ্যগত মতভেদ থাকলেও এই বিবরণী যে সাহিত্য সৃষ্টি রূপে রসোত্তীর্ণ তাতে সন্দেহ নেই। এখানে কবির আদি বাস ভূমি ত্যাগ করে পরবর্ত্তী পৃষ্ঠপোষকের গৃহে আশ্রয় লাভে গমন পর্যন্ত ব্যাক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে এই অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ বাস্তব না হতে পারে, বাস্তবের সঙ্গে রোমান্টিক কল্পনার মিশ্রণে যে জীবন সংগ্রামের ছবি অঙ্কিত হয়েছে তার সার্থকতা প্রশ্নাতীত। যদিও এরকম প্রসঙ্গের অবতারণা মঙ্গলকাব্য ধারায় প্রথাগত। তবু্ও এস্থলে মুকুন্দরামের জীবননিষ্ঠা অন্য দৃষ্টান্তের তুলনায় স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত। দুঃখ ও নির্যাতন সহ্য করে, তা থেকে পরিত্রাণ পর্যন্ত জীবনের যে আগ্রহ তাতেই এই বিবরণ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
মুকুন্দরামের কাব্যে দুঃখের বর্ণনায় স্পষ্ঠ প্রবণতা দেখা যায়। ফুল্লরার বারমাস্যা, পশুগণের নিবেদন, কলিঙ্গ দেশে বন্যায় মানুষের দুর্গতি, শিবের অভাবের সংসার, হাটুরিয়াগণের আবেদন, কোটালের প্রতি ফুল্লরার বিনয় ইত্যাদি অংশে দুঃখের প্রসঙ্গ সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। এই সব অংশের বর্ণনায় কবির দক্ষতাও প্রশ্নাতীত। কারও মনে হওয়া স্বাভাবিক যে জীবনে দুঃখের বিস্তারিত বর্ণনা গ্রন্থভুক্ত করে কবি যেন দুঃখময় জীবনের প্রতি অন্তরের দুর্বলতা প্রকাশ করে বসেছেন। জীবনে দুঃখের ভূমিকা অনস্বীকার্য, কিন্তু মুকুন্দরাম যেন অন্য বিষয়ে যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, দুঃখের প্রসঙ্গে তার থেকে তুলনায় কৃতিত্ব অনেক বেশী। কিন্তু তাই বলে মুকুন্দরামকে 'দুঃখবাদী কবি' বলাও যুক্তিযুক্ত নয়। বরং তার বদলে কবিকে বাঙালীর গার্হস্থ্য জীবনে রসের কবি বলাই সঙ্গত। কাব্য পাঠে একটু মনোযোগী হলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কবি বাঙালীর ঘরোয়া পরিবেশকে কাব্যে রূপ দিতে বেশী আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দেবনয় সব প্রসঙ্গেই সজ্জা ভোজনে-রুচি, সামাজিক আচার ও রীতিনীতি, ধর্মীয় আচরণ, দাম্পত্য জীবন, পেশা, স্নেহ মমতা, এমনকি শিকার ও যুদ্ধপ্রসঙ্গেও বাঙালীর ঘরোয়া মনোভাবটি সবার উপরে চিহ্ন রেখে গেছে। ডঃ শ্রীকূমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই অভিমত পোষণ করেন যে মুকুন্দরামের কাব্যে বাঙালীর ঘরোয়াজীবনকে আরও নূতনভাবে আস্বাদন করতে শেখা গেছে। কবির এই ধরণের প্রবণতা আরও একটু বিস্তৃত হয়ে গুজরাটে নগর পত্তন, বারনিয়াগণের বন কাটা এবং নগরে বাস করতে মানুষদের বিস্তারিত বিবরণে আত্মপ্রকাশ করেছে। কবি অভাব ও দুঃখের চাপে অবসন্ন হননি বরং অভাব ও দুঃখকে নিয়ে কৌতুকের অবতারণা করেছেন। তাই মাঝে মাঝেই ভোজনরসের আয়োজনে কাব্যের গতিকে মন্থর করতে দ্বিধা করেননি।
মুরারি শীল এবং ভাঁডু দত্তের প্রসঙ্গেও কবির রসবোধের উজ্বল সাক্ষ্য বহন করছে। এই প্রসঙ্গে কবি তাঁর জীবন অভিজ্ঞতার পূর্ণ সদব্যবহার করেছেন। মনে হয় যেন এই শ্রেণীর চরিত্র সম্পর্কে ও মুকুন্দরামের সহানুভূতি বেশী ছিল। কেননা এই কাব্যের নায়ক নায়িকা দুটিও সমাজের অবহেলিত নিম্ন শ্রেণী থেকে আগত। তাদের জীবনে কবি যে ধারা যোগ করেছেন তাতে তাদের চরিত্রগুলিও সর্বজনীন স্তরে উন্নীত হয়েছে। ব্যাধ জীবনের রীতি ও আচার বিচারের সঙ্গে বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ের আচরণীয় বিধি বিধানও অক্লেশে যুক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু কাব্যে বর্ণিত চরিত্র ও ঘটনার বিবরণে সমাজের উচ্চস্তরের তুলনায় নিম্নস্তর বেশী সহানুভূতির ভাগি হতে পেরেছে। অনুরূপভাবে ঠক প্রবঞ্চক ও ভন্ড শ্রেণীর চরিত্রগুলিও কবির কাছে বেশী মনোযোগ লাভে ধন্য হয়েছে। মুরারী শীল আবির্ভূত হয়ে কাব্যের অতি মামুলি জীবন বর্ণনায় অভাবিত প্রাণসঞ্চার করে দিয়েছে। তারপরে ভাঁডু দত্তের প্রসঙ্গ এনে কবি সমাজের প্রবঞ্চক পরজীবীশ্রেণীর ভব্যবেশের মুখোশটা খুলে দিয়েছেন। এই সব প্রসঙ্গ আসায় কাব্যের ভাবজগত যেন অপেক্ষাকৃত দেবহলীলার কল্পলোক ত্যাগ করে মর্ত্তের মাটির সঙ্গে নাড়ির যোগকে প্রত্যক্ষ করে তুলেছে।
সব মিলিয়ে মুকুন্দরামের অভয়ামঙ্গল (আখেটী খন্ড কবির কবিত্ব, চরিত্রনির্মণ, কাহিনী বয়ন সার্থক হয়ে উঠেছে তাঁর রসবোধে, জীবানুরাগ, কৌতুকসৃষ্টি, বাঙালীয়ানা, ঘরোয়া মনোভাবের অনুসরণ এবং কাব্যদেহ নির্মাণে পরিমিতি বোধের সমন্বয়ে।