পৃষ্ঠা- ৫৫, ৫৬ ও ৫৭
2020-06-28
'সীতারাম' উপন্যাসের ধম্যতত্ত্ব-ব্যাখ্যা যে বঙ্কিমের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল তাহা অবিসংবাদিত | ইহার মুখবন্ধে গীতা হইতে উদ্ধৃত শ্লোক-সমষ্টিই তাহার অখণ্ডনীয় প্রমাণ | গীতা-আলোচনার ফলে বঙ্কিমের মনে গীতোক্ত মাহাত্ম্য খুব গভীরভাবে মুদ্রিত হইয়াছিল, এবং তাহার শেষ জীবনের উপন্যাসগুলিতে ঔপন্যাসিক চরিত্রসৃষ্টি দ্বারা ও মানব-জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে তিনি এই ধম্যের বিশেষত্ব, ইহার আদশ্য ও সাধনপথে বিঘ্নসমূহ ফুটাইয়া তুলিতে চেষ্টা করিয়াছেন | কথাটা আটে্র দিক হইতে শুনিতে ভালো লাগিবে না; কিন্তু ধম্যতত্ত্ব-সম্বন্ধে একটা কথা মনে করিলে এ বিষয়ে আমাদের সন্দেহের অনেকটা নিরসন হইবে | ধম্যশাস্ত্রকারেরা যে মানবমনস্তত্ত্ববিদ ছিলেন না, এরূপ মনে করার কোনো কারণ নাই--প্রত্যুত তাঁহাদের অনেক উপদেশ-অনুশাসন মানব-মনের গভীর গ্যানের উপরেই প্রতিষ্ঠিত | বিশেষত মনের উপর পাপের সূক্ষ্ম প্রভাব ও ইহার ক্রমবৃদ্ধিসম্বন্ধে আমাদের শাস্ত্রবিদদের কল্পনা বিলক্ষণ সচেতন ছিল | 'সীতারাম' পড়িতে পড়িতে যদি আমরা ইহার গীতোক্ত ধম্যতত্ত্ব ভুলিয়া যাই, তাহা হইলেও ইহার কলাসৌন্দযে্র মানবিকতার (human interest) কোনো হানি হয় না | যাঁহারা উপন্যাসের সহিত ধম্যতত্ত্বের একটি চিরবিরোধের কল্পনা করেন, তাঁহারা ইচ্ছা করিলেই 'সীতারাম'কে ধম্যতত্ত্বের আবেষ্টন হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া, আধুনিক কালের ধম্যপ্রভাবমুক্ত মনস্তত্ত্ব-বিশ্লেষণের আবেষ্টনের মধ্যে অনায়াসেই ফেলিতে পারেন | সীতারামের মধ্যে যে দুব্যলতার বীজ নিহিত ছিল, তাহা মনুষ্য-হৃদয়ের একটি সাধারণ, চিরন্তন মোহ; গীতাকার কেবল তাহাকে একটি বিশেষ সংগ্যায় অভিহিত করিয়াছেন, উহা হইতে উদ্ধার পাইবার সাধন-পথ নিদে্শ করিয়াছেন মাত্র | বঙ্কিম তাঁহার সমৃদ্ধ কল্পনাভাণ্ডার হইতে এই বাস্তব মোহের একটি উদাহারণ লইয়াছেন; এবং যদিও সীতারামের জীবন-সমস্যার উপরে হিন্দু-সমাজ ও ধম্যতত্ত্বের প্রভাব আসিয়া ইহাকে জটিল করিয়া তুলিয়াছে--শ্রীর সহিত তাঁহার সমস্ত সম্পক্যই হিন্দুর সামাজিক ও ধম্যগত বৈশিষ্ট্যের উপর প্রতিষ্ঠিত--তথাপি তাঁহার নৈতিক অধঃপতনের চিত্রাঙ্কন ও ইহার কারণ-বিশ্লেষণ সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্বগ্যানের দ্বারাই সম্পাদিত হইয়াছে | নিতান্ত বাস্তবতা-প্রিয় পাঠকেরও এ বিষয় অসন্তুষ্ট হইবার বিশেষ কোনো কারণ নাই |
অবশ্য বঙ্কিম ধম্যতত্ত্ব ও অতিপ্রাকৃত দিকটা মোটেই অবহেলা করেন নাই--শ্রী ও জয়ন্তীর ভিতর দিয়া এই দিকটা যথেষ্ট ফুটাইয়া তুলিয়াছেন | শ্রীর সহিত সীতারামের সম্পকে্র বিশেষত্বটুকু হিন্দু-জ্যোতিষ-শাস্ত্রে বিশ্বাসেরই ফল; আবার উপন্যাসের শেষের দিকে জয়ন্তী--শিষ্যা শ্রীর সন্ন্যাসের প্রতি অবিমিশ্র নিষ্ঠাই সীতারামের চিত্ত-বিভ্রম জন্মাইয়া তাঁহার অধঃপতনের গতি দ্রুততর করিয়া দিয়াছে | কিন্তু সীতারামের নিজের জীবনের উপর ধম্যতত্ত্বের প্রভাব লক্ষিত হয় না | বঙ্কিমের কৃতিত্ব এই যে, তিনি ধম্যতত্ত্বব্যাখ্যাকে জীবনের মনস্তত্ত্বমূলক বিশ্লেষণের সহিত নিশ্চিহ্নভাবে মিলাইয়া দিয়াছেন | সীতারামের অপরিমিত রূপমোহ কীরূপে ধীরে ধীরে তাঁহার মনের উপরে আধিপত্য বিস্তার করিল ও অনুকূল ঘটনাযোগে দুদ্যমনীয় হইয়া তাঁহার রাজত্ব ও মনুষ্যত্বের যুগপৎ ধ্বংস-সাধন করিল, তাহার কাহিনীর রসোপলব্ধির জন্য আমাদের ধম্যতত্ত্বের সংকীণ্য গণ্ডির মধ্যে প্রবেশ করিবার প্রয়োজন নাই |
সীতারামের চরিত্রে অতৃপ্ত রূপমোহের দুব্যলতা যে প্রথম হইতেই সুপ্ত ছিল, তাহা বঙ্কিম বিপন্না সাহায্যপ্রাথি্নী শ্রীর সহিত তাঁহার প্রথম সাক্ষাৎ-কালেই একটি সূক্ষ্ম অথচ অথ্যপূণ্য ইঙ্গিতের দ্বারা প্রকাশ করিয়াছেন |-- "তুমি, শ্রী, এত সুন্দরী !" পিতৃ-আগ্যা-অনুসারে নিরপরাধ শ্রীকে নিশ্চিন্তভাবে পরিত্যাগ, ও তাহার সম্বন্ধে কত্যব্যবোধের সম্পূণ্য বিসজ্যন --ইহাও চরিত্র-দৌব্যল্যেরই সূচক | তাহার পর এত দিনের বিস্মৃত কত্যব্যগ্যান যে এরূপ উচ্ছ্বসিতভাবে জাগিল, শান্ত হৃদয়ে যে গভীর তরঙ্গ-বিক্ষোভ জন্মিল, তাহার মূলে, সমবেদনা, আত্মগ্লানি, প্রভৃতি সমস্ত উচ্চ-ভাবকে ছাপাইয়া যে শক্তি ছিল তাহাও এই রূপতৃষ্ণা | গঙ্গারামের জন্য তাহার অভাবনীয় আত্মোৎসগে্র প্রস্তাবও এই মূল ভাব হইতে প্রসূত | অবশ্য রূপমোহ যতই প্রবল হউক না কেন, তাহা সাধারণ প্রকৃতির লোককে এরূপ আত্মোৎসগ্যে প্রণোদিত করিতে পারে না | সীতারামের চরিত্রের অসাধারণ মহত্ত্ব না থাকিলে কোনো শক্তিই তাঁহার মনকে এত উচ্চ সুরে বাঁধিয়া দিতে পারিত না | সুতরাং এই দৃশ্য যেমন একদিকে সীতারামের স্বাভাবিক মহত্ত্বের পরিচয় দিতেছে, তেমনই অন্যদিকে তাহার উপর রূপমোহের প্রবল প্রভাবের সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে---এখানে তাঁহার মহত্ত্ব ও দুব্যলতা একই সূত্রে গ্রথিত হইয়া দেখা দিয়াছে | তার পর যুদ্ধের সময়ে শ্রীর সিংহবাহিনী মূতি্ সীতারামের অন্তরস্থ সুপ্ত উচ্চাভিলাষের দ্বারে আঘাত করিয়াছে, তাঁহার স্বাধীনতার কল্পনাকে উত্তেজিত করিয়া শ্রীর প্রতি আকষ্যণকে নিবিড়তর করিয়া তুলিয়াছে | রূপমুদ্ধ সীতারাম এই সিংহবাহিনী মূত্যি ধ্যান করিয়া তাঁহার নেশাকে আরও রঙিন করিয়া তুলিয়াছেন ও তাঁহার রূপমোহের উপরে আর একটা উন্নততর আকাঙ়ক্ষার প্রলেপ দিয়াছেন |
তারপর শ্রীর সহিত প্রথম বোঝা-পড়া; শ্রীকে পরিত্যাগ করিবার কারণ প্রকাশ করিতেই স্বামীর অমঙ্গলভয়-ভীতা শ্রীর অন্তধান | এই অপ্রাপণীয়া শ্রী সীতারামের ধ্যানে আরও উজ্জ্বলতর মূতি্ পরিগ্রহ করিতে লাগিল; শ্রী সীতারামের নিকটে অগ্যাত অনন্তের বিচিত্র-রহস্য-মণ্ডিত হইয়া উঠিল | রূপমোহ চরম পরিণতি প্রাপ্ত হইল; সমস্ত কল্পনা ও ধ্যান-ধারণার উপর জুড়িয়া বসিয়া জীবনের উপরে প্রবলতম প্রভাব হইয়া দাঁড়াইল |
এদিকে গঙ্গারামের ব্যাপার লইয়া যে সামান্য দাঙ্গা-হাঙ্গামা, তাহা একটা ক্ষুদ্র স্বাধীনতা-সংগ্রামের গৌরব ও ব্যাপকতা লাভ করিয়া বসিল | সীতারাম অনেকটা অগ্যাতসারে অনেকটা ঘটনার প্রবল স্রোতে বাধ্য হইয়া, আপনাকে একজন স্বাধীন-রাজ্যপ্রতিষ্ঠাতার আসনে আসীন দেখিতে পাইলেন | এই উত্তেজনা ও কোলাহলের সময়ে শ্রীর চিন্তার বাহ্যপ্রকাশ কতকটা মন্দীভূত হইয়া থাকিল; আত্মরক্ষা ও রাজ্যস্থাপনের প্রবল প্রয়োজন সীতারামকে শ্রীর চিন্তা হইতে কতকটা অপসৃত করিল | কিন্তু এ সময়েও তাহার অন্তরঙ্গ ইচ্ছা যে ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির ন্যায় কেবল অবসরেরই প্রতীক্ষা করিতেছিল, গ্রন্থকার তাহার প্রচুর নিদশ্যন দিয়াছেন |
তারপর আর এক দৃশ্যে সীতারামের শ্লাঘ্যতম গৌরব-শিখরে আরোহনের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহার অন্তরস্থ দুব্যলতার বীজে নববারি

নিষেক হইল | যে দিন ছদ্মবেশী সীতারাম সন্ন্যাসিনী জয়ন্তী ও শ্রীর সাহায্যে একাকী দুগ্য রক্ষা করিয়া অমানুষিক বীরত্বের পরিচয় দিলেন, সেইদিনই তাঁহার চরম গৌরবের দিন, ও শ্রীর সহিত শুভতম সম্মিলনের লগ্ন | সেই শুভদিনের পর হইতেই তাঁহার সাংসারিক ও নৈতিক উভয়বিধ অধঃপতনের আরম্ভ হইল | রাজ্যরক্ষার পুরস্কার-স্বরূপ যে রত্ন তিনি পাইলেন, তাহা তাঁহার জীবনে দীঘ্যকালসঞ্চিত দাহ্যপদাথ্যের নিকটে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতোই আসিয়া পড়িল | আবার রমার গঙ্গারাম-ঘটিত কলঙ্ক-ব্যাপার ও তাহার প্রকাশ দরবারে বিচার, একদিকে সীতারামের মনে একটা গভীর বিক্ষোভ জাগাইয়া, অন্যদিকে রমার প্রতি একটা বদ্ধমূল বিরাগের সৃষ্টি করিয়া, তাঁহাকে উন্মত্ত, সব্যগ্রাসী প্রেমের আবত্যের দিকে আরও অগ্রসর করিয়া দিল |
অতঃপর অভাবনীয়রূপে পরিবতি্তা সন্ন্যাসিনী শ্রীর সহিত মিলনের পর সীতারামের চিরপোষিত রূপতৃষ্ণা অপ্রত্যাশিত বাধা পাইয়া সাংঘাতিক বিষের ন্যায় তাঁহার সমস্ত মনে ছড়াইয়া পড়িল, তাঁহার নৈতিক জীবনের ভিত্তি পয্যন্ত টলমল করিতে লাগিল | গ্রন্থকার অতি সুন্দরভাবে এই প্রতিরুদ্ধ প্রবৃত্তির ভীষণ ক্রিয়া সীতারামের কায্যকলাপের মধ্যে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন | 'বিষবৃক্ষ' -এ জমিদার নগেন্দ্রনাথ কুন্দনন্দিনীর প্রেমে পড়িয়া ও আপনার সহিত যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হইয়া মদ খাইতে লাগিলেন, এবং দুই-একটা নিরীহ ভৃত্যকে প্রহার করিয়া নিজ অন্তদ্যাহের পরিচয় দিলেন | স্বাধীন রাজা সীতারাম, নিজ পরিণীতা ভায্যার উপর স্বামীর অধিকার প্রয়োগ করিতে না পারিয়া, উগ্রতর রক্তের নেশায় মাতাল হইয়া উঠিলেন, এবং নিজ উন্মত্তপ্রায় অস্থিরমতিত্বে একটা উপর স্বামীর অধিকার প্রয়োগ করিতে না পারিয়া, উগ্রতর রক্তের নেশায় মাতাল হইয়া উঠিলেন, এবং নিজ উন্মত্তপ্রায় অস্থিরমতিত্বে একটা রাজত্বের উপর বিশৃঙ্খলার স্রোত বহাইয়া দিলেন | এখনও সংযমের শেষ বন্ধন ছিন্ন হয় নাই; শ্রীর প্রতি প্রকৃতি প্রেম সীতারামকে পাশবিক অত্যাচারের পাপ হইতে রক্ষা করিয়াছিল | এখনও পয্যন্ত তাঁহার অপরাধ কত্যব্যচ্যুতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল, অত্যাচার ও পাপাচরণের চরম সীমা পয্যন্ত পৌছায় নাই | এই কত্যব্যচ্যুতির ফলে একদিকে রমা মরিল, অন্যদিকে চন্দ্রচূড় তিরস্কৃত হইল়ন ও রাজকম্যচারীরা শূলে গেল | তবে এখন পয্ন্ত সীতারাম নিজেরই ক্ষতি করিয়াছেন, ইন্দ্রিয়-দাস পশুতে পরিণত হন নাই |
কিন্তু এই চরম দুগ্যতি ও অধঃপতনও বাকি রহিল না | শ্রী, কতকটা নিজ সন্ন্যাস-পালন-ক্ষমতায় আস্থা হারাইয়া, কতকটা রাজার অধঃপতনের গতিরোধ করিবার জন্য, জয়ন্তীর পরামশ্যে ও তাহারই ছদ্মবেশের সাহায্যে প্রমোদ-উদ্যান হইতে অন্তহি্তা হইল | সীতারামের ক্ষিপ্ততা চরমে উঠিল; বিজাতীয় ক্রোধ আসিয়া তাঁহাকে হিংস্র পশুর ন্যায় জয়ন্তীর প্রতি দংষ্ট্রা-নখর-প্রয়োগে উত্তেজিত করিল | অন্তঃরুদ্ধ রূপতৃষ্ণা এইবার প্রচণ্ড সব্যগ্রাসী কামানলের শিখায় প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল | আত্মোৎসগ্যে প্রস্তুত হিন্দুরাজ্য-প্রতিষ্ঠাতা মহিমময় সীতারাম একটা ঘৃণিত, কামাত্য পশুতে পরিণত হইলেন | সীতারাম-চরিত্রের এই ভীষণ পরিবত্যন অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব-বিশ্লেষণের দ্বারা আমাদের সম্মুখে সম্পূণ্য স্বাভাবিক করিয়া ধরা হইয়াছে | সীতারামের এই অধঃপতনের চিত্র সব্যতোভাবে বীর ম্যাকবেথের রক্তপিপাসু পশুতে পরিণতির সহিত তুলনীয় এবং এই চরিত্র-বিশ্লেষণে বঙ্কিম সগৌরবে ধম্যতত্ত্বের ক্ষীণতম প্রভাব হইতে আপনাকে মুক্ত করিয়াছেন |
গ্রন্থের শেষ দৃশ্যে আসন্ন মৃত্যুর সম্মুখে দুগ্য-প্রাচীর-ভেদকারী কামানের শব্দ ও তাহার প্রতিধ্বনির মধ্যে সীতারামের নৈতিক পুনরুদ্ধার সাধন করিয়া গ্রন্থকার তাঁহার গভীর ধম্য-বিশ্বাসেরই পরিচয় দিয়াছেন | এইখানে ইংরেজ কবির সহিত হিন্দুগ্রন্থকারের প্রভেদ | ইংরেজ জাতি এইরূপ আকস্মিক পরিবত্যনে তাদৃশ বিশ্বাস করে না | সেই জন্য শেকসপিয়ার, তৃতীয় বিচাড্ ও ম্যাকবেথকে হিংস্র পশুবৎ রাখিয়াই, শমনসদনে পাঠাইয়াছেন, তাহাদের নৈতিক পুনরুদ্ধারের কোনো চেষ্টা করেন নাই | অবশ্য মৃত্যুর প্রাক্কালে এই সমস্ত অধঃপতিত বীরের মুখে কবি যে সমস্ত ভাব ও উদাস খেদপূণ্য বাণী দিয়াছেন, তাহাতে ইহা মনে করা অসংগত হইবে না যে, তাহাদের মধ্যে নিষ্ফল ক্ষোভ ও অনুতাপের ক্রিয়া আরম্ভ হইয়াছে | বঙ্কিমের সীতারাম এক মুহূতে্ তাঁহার সমস্ত দৌব্যল্য ও চরিত্র-হানি ধূলিজঞ্জালবৎ ঝাড়িয়া ফেলিয়াছেন; গ্রন্থের এইরূপ পরিসমাপ্তি করিয়া বঙ্কিম তাঁহার জাতিগত ও ধম্যবিশ্বাসগত বৈশিষ্ট্যেরই পরিচয় দিয়াছেন | ইহাতে বাস্তবতার বিশেষ হানি বলিয়া মনে করার কোনো কারণ নাই | পূব্যে দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি যে, প্রত্যেক জাতির একটি বিশেষ-রকম রোমান্সের দিকে প্রবণতা আছে, এবং এই রোমান্সের প্রকৃতি তাহার বাস্তব-জীবনের বিশেষত্বের উপর নিভ্যর করে | ইউরোপীয় রোমান্স আমাদের বাঙালি-জীবনের আবেষ্টনের মধ্যে ঠিক মিলিবে না; আমাদের জাতিগত ও প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের উপরই আমাদের রোমান্সের প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে | এই মানদণ্ডে বিচার করিতে গেলে সীতারামের শেষ মুহূতে্র পরিবত্যনের রোমান্স আমাদের বাস্তব জীবনের অবস্থার সহিত বেশ সুসংগতই হইয়াছে | সীতারামের পূব্যজীবনের স্বাভাবিক মহত্ত্বই এই পুনরুদ্ধারের কাযে্ সহায়তা করিয়াছে | বিশেষত বঙ্কিম যেরূপ গভীর আবেগ ও সংযত অথচ মম্যস্পশী্ সহৃদয়তার সহিত এই পরিবত্যনের কাহিনী বণ্যনা করিয়াছেন তাহাতে যে তিনি কেবল একটা সুলভ ভাবাতিরেক (sentimentality) চরিতাথ্য করিতে চাহিয়াছেন, এরূপ সন্দেহের কোনো অবসর থাকে না; তাঁহার অস্থিমজ্জাগত গভীর ধম্যভাবই এই দৃশ্যের প্রত্যেক ছত্রে ফুটিয়া উঠিয়াছে | সীতারাম-চরিত্র বঙ্কিমের অপূব্য সৃষ্টি; সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ও বাস্তবের সহিত রোমান্সের সংমিশ্রণের সুসংগতিতে ইহা পাশ্চাত্য উপন্যাসের যে-কোনো সমজাতীয় চরিত্রের সহিত সমকক্ষতার স্পধ্যা করিতে পারে |
রোমান্সের যাহা-কিছু আতিশয্য ও অসংগতি, তাহা শ্রী ও জয়ন্তীর যুগ্ম-চরিত্রের উপর দিয়াই ব্যায়িত হইয়াছে | জয়ন্তীকে আমাদের খুব সূক্ষ্মভাবে দেখিবার প্রয়োজন নাই---সে রোমান্স-প্রাসাদের একটা আবশ্যকীয় গৃহসজ্জা মাত্র | শ্রীকে সন্ন্যাসে ব্রতী করিবার জন্য ও সীতারামের জীবনে একটা প্রলয়-ঝটিয়া তুলিবার জন্য এরূপ একটা সংসার-বন্ধনশূন্যা, প্রলোভনাতীতা সন্ন্যাসিনীর প্রয়োজন ছিল; গ্রন্থকার নিজ কল্পনার ইন্দ্রজালবলে এরূপ একটি সবা্ঙ্গ্য-সম্পূণ্যা সন্ন্যাসিনীকে পাঠকের সম্মুখে হাজির করিয়াছেন---তাহার অতীত জীবনের কোনো আভাস দেন নাই | পাঠকের কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসা যে লেখক-নিদিষ্ট গণ্ডি অতিক্রম করিয়া অসুবিধাজনক প্রশ্ন

উত্থাপন করিবে, বঙ্কিমের এরূপ অভিপ্রায় ছিল না; এবং রোমান্সের জগতে এরূপ তীক্ষ্ম জিগ্যাসাপ্রবৃত্তি অনেকটা অনধিকার-প্রবেশকারী বলিয়াই বিবেচিত হইবার যোগ্য | যেমন আমাদের দ্বারপ্রান্তবাহিনী নদী কোনো সুদূর পব্যতশিখর হইতে নামিয়া আসিয়া আমাদের প্রাত্যহিক জীবন-স্রোতের সহিত আপনাকে মিলাইয়া দেয়, ও উহার অতীত জীবন সম্বন্ধে আমরা কোনো প্রশ্নই উত্থাপন করি না, সেইরূপ জয়ন্তীও অগ্যাতের রাজ্য হইতে আসিয়া উপন্যাসের কম্যস্রোতের সহিত মিশিয়া গিয়াছে | সুতরাং জয়ন্তীতে বিশেষ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য দেখিবার আশা আমরা করিতে পারি না | কিন্তু বঙ্কিম এরূপ একটি গৌণ রকমের চরিত্রেও যথেষ্ট মাধুয্য ও মানবিকতার সঞ্চার করিয়াছেন | অবশ্য শ্রীর সন্ন্যাসধম্যে দীক্ষা ও তাহার চরিত্রগত গভীর পরিবত্যন সাধনের জন্য কৃতিত্ব, আটে্র দিক হইতে, জয়ন্তীর প্রাপ্য নহে; কেননা এই পরিবত্যন পাঠকের চক্ষুর অগোচরে, যবনিকার অন্তরালে সম্পাদিত হইয়াছে | আবার শ্রীর সহিত জয়ন্তীর নিষ্কামধম্যসম্পকী্য় যে-সমস্ত দাশ্যনিক আলোচনা হইয়াছে, তাহাতেও তাহার সজীবতার পরিমাণ বাড়ে নাই | কিন্তু লঙ্কিম সন্ন্যাসের এই অশরীরী আদশ্যকে এমন অগ্নিপরীক্ষায় ফেলিয়াছেন যে, তাঁহার মুখ হইতে মানুষের মম্যের কথা বাহির হইয়া আসিয়াছে | সেই মুহূত্য হইতে জয়ন্তী আমাদের নিকট কেবল আদশ্য সন্ন্যাসিনী নহে, একটা সজীব ঘাত-প্রতিঘাত-চঞ্চল মানুষ হইয়া দাঁড়াইয়াছে | জয়ন্তীর বিচারের দৃশ্য যেমন একদিকে বঙ্কিমের বণ্যনাশক্তি ও সৃজনীপ্রতিভার পরিচয়, তেমনি অপরদিকে তাঁহার সূক্ষ্ম নৈতিক অনুভূতিরও নিদশ্যন | জয়ন্তীর মনে যে মুহূতে্ একটু সূক্ষ্ম অহংকারের ভাব প্রবেশ করিয়াছে, যে মুহূতে্ তাহার সন্ন্যাসের মধ্যে বাহ্যাড়ম্বরের একটু সামান্য স্পশ্য হইয়াছে, সেই মুহূতে়্ই স্ত্রীজাতিসুলভ লজ্জা আসিয়া তাহার সমস্ত অহংকার চূণ্য করিয়া দিয়াছে | বঙ্কিমের প্রতিভা এখানে অতিসূক্ষ্ম তাপমান-যন্ত্রের ন্যায় অন্তরস্থ অহংকারের সামান্য তারতম্য, ঈষৎ মাত্রাভেদও অভ্রান্তভাবে ধরিয়া ফেলিয়াছে |
শ্রীর চরিত্রেই উপন্যাস-মধ্যে সব্যাপেক্ষা অধিক অবাস্তবতা দৃষ্ট হয় | শ্রীর চরিত্রের গুরুতর পরিবত্যনটি আমাদের দৃষ্টির বাহিরে সাধিত হওয়ায় তাহার গৌরব অনেকটা খব্য হইয়াছে | শ্রীর স্বামিপ্রেমের যে গভীর, মম্যস্পশী্ বিবরণ পাই, তাহাতে তাহার পরিবত্যনের কাহিনীটি বিশ্বাসের উপর মানিয়া লইতে আমাদের আরও অনিচ্ছা হয় | বিশেষত ইহার পরে শ্রী জয়ন্তীর প্রভাবে পড়িয়া একেবারে নিষ্প্রভ হইয়া পড়িয়াছে; জয়ন্তীর একান্ত অনুগতা শিষ্যার অপ্রধান অংশ অধিকার করিয়াছে | সীতারামের জীবনব্যাপী আকুল বাসনা, শ্রীর নিজ অন্তঃকরণে সন্ন্যাসের আদশ্য ও স্বামিপ্রেমের মধ্যে ক্ষীণ দ্বন্দ্ব ও বিলম্বিত (belated) অনুতাপ--কিছুতেই তাহার ধমনীতে প্রাণপ্রবাহের সঞ্চার করিতে পারে নাই | শ্রী-র সিংহবাহিনীমূতি্ই আমাদের কল্পনার চক্ষে গভীর রেখায় ফুটিয়া উঠে, তাহাই আমাদের তাহার সম্বন্ধে শেষ এবং সত্য ধারণা | সন্ন্যাসিনী শ্রী একটা আদশ্যজ্যোতিম্যণ্ডলমধ্যবতি্নী মূতি্ মাত্র; সে সীতারামের অনিবা্ণ কামনার আগুনে রাঙা হইয়াও প্রভাতের স্তিমিত-জ্যোতি তারকার ন্যায় আমাদের চক্ষুর সম্মুখ হইতে অবাস্তবতায় বিলীন হইয়া গিয়াছে |
বাস্তব চরিত্রদের মধ্যে রমাই সব্যপ্রধান | রমাই আমাদিগকে উচ্চ আদশ্য ও বীরত্বের রাজ্য হইতে আমাদের প্রাত্যহিক পারিবারিক জীবনের মধ্যে টানিয়া আনিয়াছে | সীতারামের উচ্ছাভিলাষ ও স্বাধীনরাজ্য-স্থাপন তাহার দুই চক্ষের বিষ; মুসলমানের ভয় তাহার দিবসের শান্তি ও রাত্রির নিদ্রা হরণ করিয়াছে---উপন্যাসের যুদ্ধ-কোলাহল ও সন্ন্যাসধম্যের উচ্চ আদশ্যের মধ্যে সে-ই খাঁটি বাঙালি নারীর সুরটি তুলিয়াছে---একমাত্র রমাই সীতারামকে বাঙালি বলিয়া নিঃসন্দেহে চিনাইয়া দিয়াছে | কিন্তু অসাধারণ প্রতিবেশের প্রভাব এ-হেন রোদনপ্রবণা, অতিমাত্র স্নেহ-দুব্যলা নারীকেও রোমান্সের দীপ্তি ও গৌরব আনিয়া দিয়াছে | প্রথমত, গঙ্গারামকে অন্তঃপুরে আমন্ত্রণের ব্যাপারে তাহার শঙ্কাতিশয্যই তাহাকে দুঃসাহসের চরম-সীমায় ঠেলিয়া দিয়াছে | আর প্রকাশ্য দরবারে বিচারের দিন পুত্রস্নেহ তাহার সমস্ত লজ্জা-সংকোচ-দুব্যলতাকে সরাইয়া দিয়া তাহার কণ্ঠ অতুলনীয় বাগ্মিতায় ভরিয়া দিয়াছে, এবং সেই ক্ষীণপ্রাণা রমণীর উপর মহামহিমময়ী সম্রাগ্যীর জয়মুকুট পরাইয়াছে | রোমান্সের অসাধারণত্ব ও আমাদের সাধারণ জীবনের উপরে তাহার অননুমেয় প্রভাব-সম্বন্ধে বঙ্কিমের দৃষ্টি কত তীক্ষ্ণ ছিল, রমা চরিত্র তাহার প্রকৃষ্ট উদাহরণ | সীতারামের অবহেলাজনিত শোচনীয় মৃত্যু তাহার পাণ্ডুর মুখে একটা করুণ আভা আনিয়াছে, এবং মনস্তত্ত্ব-বিশ্লেষণের দিক দিয়াও, সীতারামের অধোগতির একটি সোপানস্বরূপেও, উপন্যাসে তাহার সাথ্যকতা আছে |
অন্যান্য চরিত্রের বিস্তারিত আলোচনার বিশেষ প্রয়োজন নাই | গঙ্গারামের বিশ্বাসঘাতকতা একটা অতকি্ত বিকাশ বলিয়াই প্রথম দৃষ্টিতে অনুভুত হয় | কিন্তু লেখক উপন্যাসের প্রথম অংশে তাহার আত্মসব্যস্বতার একটা ক্ষুদ্র ইঙ্গিত দিয়া বোধ হয় তাহার শোচনীয় পরিণামের জন্য আমাদিগকে কতকাংশে প্রস্তুত করিতে তাহিয়াছেন | কাজীর নিকট গঙ্গারামের বিচারের দিন, সীতারাম তাহার উদ্ধারের জন্য কতখানি আয়োজন করিয়াছেন, মুসলমানের সহিত লড়াই করিবার জন্য কতখানি প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছেন, তাহা গঙ্গারামের জানিবার কোনো উপায় ছিল না; তাহার সহিত কায্যপ্রণালী-সম্বন্ধে সীতারামের নিশ্চয় কোনো পরামশ্য হইতে পারে নাই | অথচ গঙ্গারাম আত্মরক্ষা ব্যাতীত অন্য কিছু না ভাবিয়া সীতারামকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ফেলিয়া রাখিয়া সীতারামের নিশ্চয় কোনো পরামশ্য হইতে পারে নাই | অথচ গঙ্গারাম আত্মরক্ষা ব্যতীত অন্য কিছু না ভাবিয়া সীতারামকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ফেলিয়া রাখিয়া সীতারামের অশ্বপৃষ্ঠে চড়িয়া অনায়াসে পলায়ন করিল | অবশ্য কামারকে ঘুষ দিয়া গঙ্গারামের হাত-পা বেড়ি-মুক্ত করিয়া লওয়াতে গঙ্গারামের সহিত পূব্য-পরামশ্যের একটা ক্ষীণ আভাস পাওয়া যাইতে পারে; কিন্তু বোধ হয় ইহার উদ্দেশ্য এই যে, সুযোগ উপস্থিত যাহাতে গঙ্গারামের পলায়নের পক্ষে কোনো বিঘ্ন না থাকে তাহার ব্যবস্থা করা | গঙ্গারাম যে এরূপ অতকি্তভাবে ও অপরকে বিপদে ফেলিয়া নিজ পলায়নের উপায় নিজেই করিয়া লইবে, কোনো উপদেশের অপেক্ষা রাখিবে না, ইহার জন্য বোধ হয় কেহই প্রস্তুত ছিল না | গ্রন্থকার গ্রন্থের প্রারম্ভেই গঙ্গারামের মধ্যে স্বাথ্যপরতার বীজের অস্তিত্ব দেখাইয়াছেন; পরে যাহা ঘটিয়াছে, তাহা অনুকূল ঘটনার আশ্রয়ে এই মৌলিক স্বাথ্যপরতার স্বাভাবিক পরিণতি মাত্র |
অবশ্য বঙ্কিম ধম্যতত্ত্ব ও অতিপ্রাকৃত দিকটা মোটেই অবহেলা করেন নাই--শ্রী ও জয়ন্তীর ভিতর দিয়া এই দিকটা যথেষ্ট ফুটাইয়া তুলিয়াছেন | শ্রীর সহিত সীতারামের সম্পকে্র বিশেষত্বটুকু হিন্দু-জ্যোতিষ-শাস্ত্রে বিশ্বাসেরই ফল; আবার উপন্যাসের শেষের দিকে জয়ন্তী--শিষ্যা শ্রীর সন্ন্যাসের প্রতি অবিমিশ্র নিষ্ঠাই সীতারামের চিত্ত-বিভ্রম জন্মাইয়া তাঁহার অধঃপতনের গতি দ্রুততর করিয়া দিয়াছে | কিন্তু সীতারামের নিজের জীবনের উপর ধম্যতত্ত্বের প্রভাব লক্ষিত হয় না | বঙ্কিমের কৃতিত্ব এই যে, তিনি ধম্যতত্ত্বব্যাখ্যাকে জীবনের মনস্তত্ত্বমূলক বিশ্লেষণের সহিত নিশ্চিহ্নভাবে মিলাইয়া দিয়াছেন | সীতারামের অপরিমিত রূপমোহ কীরূপে ধীরে ধীরে তাঁহার মনের উপরে আধিপত্য বিস্তার করিল ও অনুকূল ঘটনাযোগে দুদ্যমনীয় হইয়া তাঁহার রাজত্ব ও মনুষ্যত্বের যুগপৎ ধ্বংস-সাধন করিল, তাহার কাহিনীর রসোপলব্ধির জন্য আমাদের ধম্যতত্ত্বের সংকীণ্য গণ্ডির মধ্যে প্রবেশ করিবার প্রয়োজন নাই |
সীতারামের চরিত্রে অতৃপ্ত রূপমোহের দুব্যলতা যে প্রথম হইতেই সুপ্ত ছিল, তাহা বঙ্কিম বিপন্না সাহায্যপ্রাথি্নী শ্রীর সহিত তাঁহার প্রথম সাক্ষাৎ-কালেই একটি সূক্ষ্ম অথচ অথ্যপূণ্য ইঙ্গিতের দ্বারা প্রকাশ করিয়াছেন |-- "তুমি, শ্রী, এত সুন্দরী !" পিতৃ-আগ্যা-অনুসারে নিরপরাধ শ্রীকে নিশ্চিন্তভাবে পরিত্যাগ, ও তাহার সম্বন্ধে কত্যব্যবোধের সম্পূণ্য বিসজ্যন --ইহাও চরিত্র-দৌব্যল্যেরই সূচক | তাহার পর এত দিনের বিস্মৃত কত্যব্যগ্যান যে এরূপ উচ্ছ্বসিতভাবে জাগিল, শান্ত হৃদয়ে যে গভীর তরঙ্গ-বিক্ষোভ জন্মিল, তাহার মূলে, সমবেদনা, আত্মগ্লানি, প্রভৃতি সমস্ত উচ্চ-ভাবকে ছাপাইয়া যে শক্তি ছিল তাহাও এই রূপতৃষ্ণা | গঙ্গারামের জন্য তাহার অভাবনীয় আত্মোৎসগে্র প্রস্তাবও এই মূল ভাব হইতে প্রসূত | অবশ্য রূপমোহ যতই প্রবল হউক না কেন, তাহা সাধারণ প্রকৃতির লোককে এরূপ আত্মোৎসগ্যে প্রণোদিত করিতে পারে না | সীতারামের চরিত্রের অসাধারণ মহত্ত্ব না থাকিলে কোনো শক্তিই তাঁহার মনকে এত উচ্চ সুরে বাঁধিয়া দিতে পারিত না | সুতরাং এই দৃশ্য যেমন একদিকে সীতারামের স্বাভাবিক মহত্ত্বের পরিচয় দিতেছে, তেমনই অন্যদিকে তাহার উপর রূপমোহের প্রবল প্রভাবের সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে---এখানে তাঁহার মহত্ত্ব ও দুব্যলতা একই সূত্রে গ্রথিত হইয়া দেখা দিয়াছে | তার পর যুদ্ধের সময়ে শ্রীর সিংহবাহিনী মূতি্ সীতারামের অন্তরস্থ সুপ্ত উচ্চাভিলাষের দ্বারে আঘাত করিয়াছে, তাঁহার স্বাধীনতার কল্পনাকে উত্তেজিত করিয়া শ্রীর প্রতি আকষ্যণকে নিবিড়তর করিয়া তুলিয়াছে | রূপমুদ্ধ সীতারাম এই সিংহবাহিনী মূত্যি ধ্যান করিয়া তাঁহার নেশাকে আরও রঙিন করিয়া তুলিয়াছেন ও তাঁহার রূপমোহের উপরে আর একটা উন্নততর আকাঙ়ক্ষার প্রলেপ দিয়াছেন |
তারপর শ্রীর সহিত প্রথম বোঝা-পড়া; শ্রীকে পরিত্যাগ করিবার কারণ প্রকাশ করিতেই স্বামীর অমঙ্গলভয়-ভীতা শ্রীর অন্তধান | এই অপ্রাপণীয়া শ্রী সীতারামের ধ্যানে আরও উজ্জ্বলতর মূতি্ পরিগ্রহ করিতে লাগিল; শ্রী সীতারামের নিকটে অগ্যাত অনন্তের বিচিত্র-রহস্য-মণ্ডিত হইয়া উঠিল | রূপমোহ চরম পরিণতি প্রাপ্ত হইল; সমস্ত কল্পনা ও ধ্যান-ধারণার উপর জুড়িয়া বসিয়া জীবনের উপরে প্রবলতম প্রভাব হইয়া দাঁড়াইল |
এদিকে গঙ্গারামের ব্যাপার লইয়া যে সামান্য দাঙ্গা-হাঙ্গামা, তাহা একটা ক্ষুদ্র স্বাধীনতা-সংগ্রামের গৌরব ও ব্যাপকতা লাভ করিয়া বসিল | সীতারাম অনেকটা অগ্যাতসারে অনেকটা ঘটনার প্রবল স্রোতে বাধ্য হইয়া, আপনাকে একজন স্বাধীন-রাজ্যপ্রতিষ্ঠাতার আসনে আসীন দেখিতে পাইলেন | এই উত্তেজনা ও কোলাহলের সময়ে শ্রীর চিন্তার বাহ্যপ্রকাশ কতকটা মন্দীভূত হইয়া থাকিল; আত্মরক্ষা ও রাজ্যস্থাপনের প্রবল প্রয়োজন সীতারামকে শ্রীর চিন্তা হইতে কতকটা অপসৃত করিল | কিন্তু এ সময়েও তাহার অন্তরঙ্গ ইচ্ছা যে ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির ন্যায় কেবল অবসরেরই প্রতীক্ষা করিতেছিল, গ্রন্থকার তাহার প্রচুর নিদশ্যন দিয়াছেন |
তারপর আর এক দৃশ্যে সীতারামের শ্লাঘ্যতম গৌরব-শিখরে আরোহনের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহার অন্তরস্থ দুব্যলতার বীজে নববারি

নিষেক হইল | যে দিন ছদ্মবেশী সীতারাম সন্ন্যাসিনী জয়ন্তী ও শ্রীর সাহায্যে একাকী দুগ্য রক্ষা করিয়া অমানুষিক বীরত্বের পরিচয় দিলেন, সেইদিনই তাঁহার চরম গৌরবের দিন, ও শ্রীর সহিত শুভতম সম্মিলনের লগ্ন | সেই শুভদিনের পর হইতেই তাঁহার সাংসারিক ও নৈতিক উভয়বিধ অধঃপতনের আরম্ভ হইল | রাজ্যরক্ষার পুরস্কার-স্বরূপ যে রত্ন তিনি পাইলেন, তাহা তাঁহার জীবনে দীঘ্যকালসঞ্চিত দাহ্যপদাথ্যের নিকটে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতোই আসিয়া পড়িল | আবার রমার গঙ্গারাম-ঘটিত কলঙ্ক-ব্যাপার ও তাহার প্রকাশ দরবারে বিচার, একদিকে সীতারামের মনে একটা গভীর বিক্ষোভ জাগাইয়া, অন্যদিকে রমার প্রতি একটা বদ্ধমূল বিরাগের সৃষ্টি করিয়া, তাঁহাকে উন্মত্ত, সব্যগ্রাসী প্রেমের আবত্যের দিকে আরও অগ্রসর করিয়া দিল |
অতঃপর অভাবনীয়রূপে পরিবতি্তা সন্ন্যাসিনী শ্রীর সহিত মিলনের পর সীতারামের চিরপোষিত রূপতৃষ্ণা অপ্রত্যাশিত বাধা পাইয়া সাংঘাতিক বিষের ন্যায় তাঁহার সমস্ত মনে ছড়াইয়া পড়িল, তাঁহার নৈতিক জীবনের ভিত্তি পয্যন্ত টলমল করিতে লাগিল | গ্রন্থকার অতি সুন্দরভাবে এই প্রতিরুদ্ধ প্রবৃত্তির ভীষণ ক্রিয়া সীতারামের কায্যকলাপের মধ্যে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন | 'বিষবৃক্ষ' -এ জমিদার নগেন্দ্রনাথ কুন্দনন্দিনীর প্রেমে পড়িয়া ও আপনার সহিত যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হইয়া মদ খাইতে লাগিলেন, এবং দুই-একটা নিরীহ ভৃত্যকে প্রহার করিয়া নিজ অন্তদ্যাহের পরিচয় দিলেন | স্বাধীন রাজা সীতারাম, নিজ পরিণীতা ভায্যার উপর স্বামীর অধিকার প্রয়োগ করিতে না পারিয়া, উগ্রতর রক্তের নেশায় মাতাল হইয়া উঠিলেন, এবং নিজ উন্মত্তপ্রায় অস্থিরমতিত্বে একটা উপর স্বামীর অধিকার প্রয়োগ করিতে না পারিয়া, উগ্রতর রক্তের নেশায় মাতাল হইয়া উঠিলেন, এবং নিজ উন্মত্তপ্রায় অস্থিরমতিত্বে একটা রাজত্বের উপর বিশৃঙ্খলার স্রোত বহাইয়া দিলেন | এখনও সংযমের শেষ বন্ধন ছিন্ন হয় নাই; শ্রীর প্রতি প্রকৃতি প্রেম সীতারামকে পাশবিক অত্যাচারের পাপ হইতে রক্ষা করিয়াছিল | এখনও পয্যন্ত তাঁহার অপরাধ কত্যব্যচ্যুতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল, অত্যাচার ও পাপাচরণের চরম সীমা পয্যন্ত পৌছায় নাই | এই কত্যব্যচ্যুতির ফলে একদিকে রমা মরিল, অন্যদিকে চন্দ্রচূড় তিরস্কৃত হইল়ন ও রাজকম্যচারীরা শূলে গেল | তবে এখন পয্ন্ত সীতারাম নিজেরই ক্ষতি করিয়াছেন, ইন্দ্রিয়-দাস পশুতে পরিণত হন নাই |
কিন্তু এই চরম দুগ্যতি ও অধঃপতনও বাকি রহিল না | শ্রী, কতকটা নিজ সন্ন্যাস-পালন-ক্ষমতায় আস্থা হারাইয়া, কতকটা রাজার অধঃপতনের গতিরোধ করিবার জন্য, জয়ন্তীর পরামশ্যে ও তাহারই ছদ্মবেশের সাহায্যে প্রমোদ-উদ্যান হইতে অন্তহি্তা হইল | সীতারামের ক্ষিপ্ততা চরমে উঠিল; বিজাতীয় ক্রোধ আসিয়া তাঁহাকে হিংস্র পশুর ন্যায় জয়ন্তীর প্রতি দংষ্ট্রা-নখর-প্রয়োগে উত্তেজিত করিল | অন্তঃরুদ্ধ রূপতৃষ্ণা এইবার প্রচণ্ড সব্যগ্রাসী কামানলের শিখায় প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল | আত্মোৎসগ্যে প্রস্তুত হিন্দুরাজ্য-প্রতিষ্ঠাতা মহিমময় সীতারাম একটা ঘৃণিত, কামাত্য পশুতে পরিণত হইলেন | সীতারাম-চরিত্রের এই ভীষণ পরিবত্যন অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব-বিশ্লেষণের দ্বারা আমাদের সম্মুখে সম্পূণ্য স্বাভাবিক করিয়া ধরা হইয়াছে | সীতারামের এই অধঃপতনের চিত্র সব্যতোভাবে বীর ম্যাকবেথের রক্তপিপাসু পশুতে পরিণতির সহিত তুলনীয় এবং এই চরিত্র-বিশ্লেষণে বঙ্কিম সগৌরবে ধম্যতত্ত্বের ক্ষীণতম প্রভাব হইতে আপনাকে মুক্ত করিয়াছেন |
গ্রন্থের শেষ দৃশ্যে আসন্ন মৃত্যুর সম্মুখে দুগ্য-প্রাচীর-ভেদকারী কামানের শব্দ ও তাহার প্রতিধ্বনির মধ্যে সীতারামের নৈতিক পুনরুদ্ধার সাধন করিয়া গ্রন্থকার তাঁহার গভীর ধম্য-বিশ্বাসেরই পরিচয় দিয়াছেন | এইখানে ইংরেজ কবির সহিত হিন্দুগ্রন্থকারের প্রভেদ | ইংরেজ জাতি এইরূপ আকস্মিক পরিবত্যনে তাদৃশ বিশ্বাস করে না | সেই জন্য শেকসপিয়ার, তৃতীয় বিচাড্ ও ম্যাকবেথকে হিংস্র পশুবৎ রাখিয়াই, শমনসদনে পাঠাইয়াছেন, তাহাদের নৈতিক পুনরুদ্ধারের কোনো চেষ্টা করেন নাই | অবশ্য মৃত্যুর প্রাক্কালে এই সমস্ত অধঃপতিত বীরের মুখে কবি যে সমস্ত ভাব ও উদাস খেদপূণ্য বাণী দিয়াছেন, তাহাতে ইহা মনে করা অসংগত হইবে না যে, তাহাদের মধ্যে নিষ্ফল ক্ষোভ ও অনুতাপের ক্রিয়া আরম্ভ হইয়াছে | বঙ্কিমের সীতারাম এক মুহূতে্ তাঁহার সমস্ত দৌব্যল্য ও চরিত্র-হানি ধূলিজঞ্জালবৎ ঝাড়িয়া ফেলিয়াছেন; গ্রন্থের এইরূপ পরিসমাপ্তি করিয়া বঙ্কিম তাঁহার জাতিগত ও ধম্যবিশ্বাসগত বৈশিষ্ট্যেরই পরিচয় দিয়াছেন | ইহাতে বাস্তবতার বিশেষ হানি বলিয়া মনে করার কোনো কারণ নাই | পূব্যে দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি যে, প্রত্যেক জাতির একটি বিশেষ-রকম রোমান্সের দিকে প্রবণতা আছে, এবং এই রোমান্সের প্রকৃতি তাহার বাস্তব-জীবনের বিশেষত্বের উপর নিভ্যর করে | ইউরোপীয় রোমান্স আমাদের বাঙালি-জীবনের আবেষ্টনের মধ্যে ঠিক মিলিবে না; আমাদের জাতিগত ও প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের উপরই আমাদের রোমান্সের প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে | এই মানদণ্ডে বিচার করিতে গেলে সীতারামের শেষ মুহূতে্র পরিবত্যনের রোমান্স আমাদের বাস্তব জীবনের অবস্থার সহিত বেশ সুসংগতই হইয়াছে | সীতারামের পূব্যজীবনের স্বাভাবিক মহত্ত্বই এই পুনরুদ্ধারের কাযে্ সহায়তা করিয়াছে | বিশেষত বঙ্কিম যেরূপ গভীর আবেগ ও সংযত অথচ মম্যস্পশী্ সহৃদয়তার সহিত এই পরিবত্যনের কাহিনী বণ্যনা করিয়াছেন তাহাতে যে তিনি কেবল একটা সুলভ ভাবাতিরেক (sentimentality) চরিতাথ্য করিতে চাহিয়াছেন, এরূপ সন্দেহের কোনো অবসর থাকে না; তাঁহার অস্থিমজ্জাগত গভীর ধম্যভাবই এই দৃশ্যের প্রত্যেক ছত্রে ফুটিয়া উঠিয়াছে | সীতারাম-চরিত্র বঙ্কিমের অপূব্য সৃষ্টি; সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ও বাস্তবের সহিত রোমান্সের সংমিশ্রণের সুসংগতিতে ইহা পাশ্চাত্য উপন্যাসের যে-কোনো সমজাতীয় চরিত্রের সহিত সমকক্ষতার স্পধ্যা করিতে পারে |
রোমান্সের যাহা-কিছু আতিশয্য ও অসংগতি, তাহা শ্রী ও জয়ন্তীর যুগ্ম-চরিত্রের উপর দিয়াই ব্যায়িত হইয়াছে | জয়ন্তীকে আমাদের খুব সূক্ষ্মভাবে দেখিবার প্রয়োজন নাই---সে রোমান্স-প্রাসাদের একটা আবশ্যকীয় গৃহসজ্জা মাত্র | শ্রীকে সন্ন্যাসে ব্রতী করিবার জন্য ও সীতারামের জীবনে একটা প্রলয়-ঝটিয়া তুলিবার জন্য এরূপ একটা সংসার-বন্ধনশূন্যা, প্রলোভনাতীতা সন্ন্যাসিনীর প্রয়োজন ছিল; গ্রন্থকার নিজ কল্পনার ইন্দ্রজালবলে এরূপ একটি সবা্ঙ্গ্য-সম্পূণ্যা সন্ন্যাসিনীকে পাঠকের সম্মুখে হাজির করিয়াছেন---তাহার অতীত জীবনের কোনো আভাস দেন নাই | পাঠকের কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসা যে লেখক-নিদিষ্ট গণ্ডি অতিক্রম করিয়া অসুবিধাজনক প্রশ্ন

উত্থাপন করিবে, বঙ্কিমের এরূপ অভিপ্রায় ছিল না; এবং রোমান্সের জগতে এরূপ তীক্ষ্ম জিগ্যাসাপ্রবৃত্তি অনেকটা অনধিকার-প্রবেশকারী বলিয়াই বিবেচিত হইবার যোগ্য | যেমন আমাদের দ্বারপ্রান্তবাহিনী নদী কোনো সুদূর পব্যতশিখর হইতে নামিয়া আসিয়া আমাদের প্রাত্যহিক জীবন-স্রোতের সহিত আপনাকে মিলাইয়া দেয়, ও উহার অতীত জীবন সম্বন্ধে আমরা কোনো প্রশ্নই উত্থাপন করি না, সেইরূপ জয়ন্তীও অগ্যাতের রাজ্য হইতে আসিয়া উপন্যাসের কম্যস্রোতের সহিত মিশিয়া গিয়াছে | সুতরাং জয়ন্তীতে বিশেষ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য দেখিবার আশা আমরা করিতে পারি না | কিন্তু বঙ্কিম এরূপ একটি গৌণ রকমের চরিত্রেও যথেষ্ট মাধুয্য ও মানবিকতার সঞ্চার করিয়াছেন | অবশ্য শ্রীর সন্ন্যাসধম্যে দীক্ষা ও তাহার চরিত্রগত গভীর পরিবত্যন সাধনের জন্য কৃতিত্ব, আটে্র দিক হইতে, জয়ন্তীর প্রাপ্য নহে; কেননা এই পরিবত্যন পাঠকের চক্ষুর অগোচরে, যবনিকার অন্তরালে সম্পাদিত হইয়াছে | আবার শ্রীর সহিত জয়ন্তীর নিষ্কামধম্যসম্পকী্য় যে-সমস্ত দাশ্যনিক আলোচনা হইয়াছে, তাহাতেও তাহার সজীবতার পরিমাণ বাড়ে নাই | কিন্তু লঙ্কিম সন্ন্যাসের এই অশরীরী আদশ্যকে এমন অগ্নিপরীক্ষায় ফেলিয়াছেন যে, তাঁহার মুখ হইতে মানুষের মম্যের কথা বাহির হইয়া আসিয়াছে | সেই মুহূত্য হইতে জয়ন্তী আমাদের নিকট কেবল আদশ্য সন্ন্যাসিনী নহে, একটা সজীব ঘাত-প্রতিঘাত-চঞ্চল মানুষ হইয়া দাঁড়াইয়াছে | জয়ন্তীর বিচারের দৃশ্য যেমন একদিকে বঙ্কিমের বণ্যনাশক্তি ও সৃজনীপ্রতিভার পরিচয়, তেমনি অপরদিকে তাঁহার সূক্ষ্ম নৈতিক অনুভূতিরও নিদশ্যন | জয়ন্তীর মনে যে মুহূতে্ একটু সূক্ষ্ম অহংকারের ভাব প্রবেশ করিয়াছে, যে মুহূতে্ তাহার সন্ন্যাসের মধ্যে বাহ্যাড়ম্বরের একটু সামান্য স্পশ্য হইয়াছে, সেই মুহূতে়্ই স্ত্রীজাতিসুলভ লজ্জা আসিয়া তাহার সমস্ত অহংকার চূণ্য করিয়া দিয়াছে | বঙ্কিমের প্রতিভা এখানে অতিসূক্ষ্ম তাপমান-যন্ত্রের ন্যায় অন্তরস্থ অহংকারের সামান্য তারতম্য, ঈষৎ মাত্রাভেদও অভ্রান্তভাবে ধরিয়া ফেলিয়াছে |
শ্রীর চরিত্রেই উপন্যাস-মধ্যে সব্যাপেক্ষা অধিক অবাস্তবতা দৃষ্ট হয় | শ্রীর চরিত্রের গুরুতর পরিবত্যনটি আমাদের দৃষ্টির বাহিরে সাধিত হওয়ায় তাহার গৌরব অনেকটা খব্য হইয়াছে | শ্রীর স্বামিপ্রেমের যে গভীর, মম্যস্পশী্ বিবরণ পাই, তাহাতে তাহার পরিবত্যনের কাহিনীটি বিশ্বাসের উপর মানিয়া লইতে আমাদের আরও অনিচ্ছা হয় | বিশেষত ইহার পরে শ্রী জয়ন্তীর প্রভাবে পড়িয়া একেবারে নিষ্প্রভ হইয়া পড়িয়াছে; জয়ন্তীর একান্ত অনুগতা শিষ্যার অপ্রধান অংশ অধিকার করিয়াছে | সীতারামের জীবনব্যাপী আকুল বাসনা, শ্রীর নিজ অন্তঃকরণে সন্ন্যাসের আদশ্য ও স্বামিপ্রেমের মধ্যে ক্ষীণ দ্বন্দ্ব ও বিলম্বিত (belated) অনুতাপ--কিছুতেই তাহার ধমনীতে প্রাণপ্রবাহের সঞ্চার করিতে পারে নাই | শ্রী-র সিংহবাহিনীমূতি্ই আমাদের কল্পনার চক্ষে গভীর রেখায় ফুটিয়া উঠে, তাহাই আমাদের তাহার সম্বন্ধে শেষ এবং সত্য ধারণা | সন্ন্যাসিনী শ্রী একটা আদশ্যজ্যোতিম্যণ্ডলমধ্যবতি্নী মূতি্ মাত্র; সে সীতারামের অনিবা্ণ কামনার আগুনে রাঙা হইয়াও প্রভাতের স্তিমিত-জ্যোতি তারকার ন্যায় আমাদের চক্ষুর সম্মুখ হইতে অবাস্তবতায় বিলীন হইয়া গিয়াছে |
বাস্তব চরিত্রদের মধ্যে রমাই সব্যপ্রধান | রমাই আমাদিগকে উচ্চ আদশ্য ও বীরত্বের রাজ্য হইতে আমাদের প্রাত্যহিক পারিবারিক জীবনের মধ্যে টানিয়া আনিয়াছে | সীতারামের উচ্ছাভিলাষ ও স্বাধীনরাজ্য-স্থাপন তাহার দুই চক্ষের বিষ; মুসলমানের ভয় তাহার দিবসের শান্তি ও রাত্রির নিদ্রা হরণ করিয়াছে---উপন্যাসের যুদ্ধ-কোলাহল ও সন্ন্যাসধম্যের উচ্চ আদশ্যের মধ্যে সে-ই খাঁটি বাঙালি নারীর সুরটি তুলিয়াছে---একমাত্র রমাই সীতারামকে বাঙালি বলিয়া নিঃসন্দেহে চিনাইয়া দিয়াছে | কিন্তু অসাধারণ প্রতিবেশের প্রভাব এ-হেন রোদনপ্রবণা, অতিমাত্র স্নেহ-দুব্যলা নারীকেও রোমান্সের দীপ্তি ও গৌরব আনিয়া দিয়াছে | প্রথমত, গঙ্গারামকে অন্তঃপুরে আমন্ত্রণের ব্যাপারে তাহার শঙ্কাতিশয্যই তাহাকে দুঃসাহসের চরম-সীমায় ঠেলিয়া দিয়াছে | আর প্রকাশ্য দরবারে বিচারের দিন পুত্রস্নেহ তাহার সমস্ত লজ্জা-সংকোচ-দুব্যলতাকে সরাইয়া দিয়া তাহার কণ্ঠ অতুলনীয় বাগ্মিতায় ভরিয়া দিয়াছে, এবং সেই ক্ষীণপ্রাণা রমণীর উপর মহামহিমময়ী সম্রাগ্যীর জয়মুকুট পরাইয়াছে | রোমান্সের অসাধারণত্ব ও আমাদের সাধারণ জীবনের উপরে তাহার অননুমেয় প্রভাব-সম্বন্ধে বঙ্কিমের দৃষ্টি কত তীক্ষ্ণ ছিল, রমা চরিত্র তাহার প্রকৃষ্ট উদাহরণ | সীতারামের অবহেলাজনিত শোচনীয় মৃত্যু তাহার পাণ্ডুর মুখে একটা করুণ আভা আনিয়াছে, এবং মনস্তত্ত্ব-বিশ্লেষণের দিক দিয়াও, সীতারামের অধোগতির একটি সোপানস্বরূপেও, উপন্যাসে তাহার সাথ্যকতা আছে |
অন্যান্য চরিত্রের বিস্তারিত আলোচনার বিশেষ প্রয়োজন নাই | গঙ্গারামের বিশ্বাসঘাতকতা একটা অতকি্ত বিকাশ বলিয়াই প্রথম দৃষ্টিতে অনুভুত হয় | কিন্তু লেখক উপন্যাসের প্রথম অংশে তাহার আত্মসব্যস্বতার একটা ক্ষুদ্র ইঙ্গিত দিয়া বোধ হয় তাহার শোচনীয় পরিণামের জন্য আমাদিগকে কতকাংশে প্রস্তুত করিতে তাহিয়াছেন | কাজীর নিকট গঙ্গারামের বিচারের দিন, সীতারাম তাহার উদ্ধারের জন্য কতখানি আয়োজন করিয়াছেন, মুসলমানের সহিত লড়াই করিবার জন্য কতখানি প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছেন, তাহা গঙ্গারামের জানিবার কোনো উপায় ছিল না; তাহার সহিত কায্যপ্রণালী-সম্বন্ধে সীতারামের নিশ্চয় কোনো পরামশ্য হইতে পারে নাই | অথচ গঙ্গারাম আত্মরক্ষা ব্যাতীত অন্য কিছু না ভাবিয়া সীতারামকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ফেলিয়া রাখিয়া সীতারামের নিশ্চয় কোনো পরামশ্য হইতে পারে নাই | অথচ গঙ্গারাম আত্মরক্ষা ব্যতীত অন্য কিছু না ভাবিয়া সীতারামকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ফেলিয়া রাখিয়া সীতারামের অশ্বপৃষ্ঠে চড়িয়া অনায়াসে পলায়ন করিল | অবশ্য কামারকে ঘুষ দিয়া গঙ্গারামের হাত-পা বেড়ি-মুক্ত করিয়া লওয়াতে গঙ্গারামের সহিত পূব্য-পরামশ্যের একটা ক্ষীণ আভাস পাওয়া যাইতে পারে; কিন্তু বোধ হয় ইহার উদ্দেশ্য এই যে, সুযোগ উপস্থিত যাহাতে গঙ্গারামের পলায়নের পক্ষে কোনো বিঘ্ন না থাকে তাহার ব্যবস্থা করা | গঙ্গারাম যে এরূপ অতকি্তভাবে ও অপরকে বিপদে ফেলিয়া নিজ পলায়নের উপায় নিজেই করিয়া লইবে, কোনো উপদেশের অপেক্ষা রাখিবে না, ইহার জন্য বোধ হয় কেহই প্রস্তুত ছিল না | গ্রন্থকার গ্রন্থের প্রারম্ভেই গঙ্গারামের মধ্যে স্বাথ্যপরতার বীজের অস্তিত্ব দেখাইয়াছেন; পরে যাহা ঘটিয়াছে, তাহা অনুকূল ঘটনার আশ্রয়ে এই মৌলিক স্বাথ্যপরতার স্বাভাবিক পরিণতি মাত্র |